Title.



সেদিন আট জুলাই। অনেকদিন পর সামহ্যয়ারইনে ডুকে তসলিমা নাসরিন লিখে সার্চ দিলাম। কোন কারণ নেই, তবু দিলাম। এমনিতেই। দেখতে দেখতে একটা পোস্ট চোখে পড়ল। নাম - তসলিমা নাসরিনের দেশপ্রেমমূলক কবিতা
যে কবিতাটা ওই পোস্টে দেয়া হয়েছে , তার থেকে জঘন্য কিছু আর হয় না। ওটা তসলিমা নাসরিনের কবিতা নয়। পোস্টটায় দাবি করা হয়েছে কবিতাটা কলকাতার 'দেশ' এ প্রকাশিত। মোটেও নয়। দেশ কেন, কোন পত্রিকাতেই ওই কবিতা বেরোয়নি। বেরিয়েছে এই ব্লগে। এবং এর লেখক পোস্ট লেখক নিজেই, অর্থাৎ জাহের ওয়াসিম। জাহের যদি প্রমাণ দেখাতে পারেন তসলিমা নাসরিনই ওই কবিতা লিখেছেন, আমি নাকে খত দেব। জাহের যদি বলেন কমোডের পানি খেতে তাও খাব। জাহের পারলে যেন দেশ'র স্ক্যান্ড পাতাটা বা অনলাইন লিঙ্ক দেয়। আর সেইসাথে জানায় যে কত তারিখে ওই দেশ সংখ্যাটা প্রকাশিত।

নিচে তসলিমা নাসরিনের সবক'টা দেশাত্মবোধক কবিতা দেওয়া হল।

কাব্যগ্রন্থঃশিকড়ে বিপুল ক্ষুধা

চাই বিশুদ্ধ বাতাস

ক্রমশ বাড়ছে খুব নিশ্বাসের কষ্টগুলো, প্রগাঢ় বিষাদ
ভেতরে ভাঙচুর শেষে নিভৃত কবাট খুলে প্রাঙ্গণে দাঁড়াই
জোস্নার শরীর ঘিরে উন্মথিত হাওয়া নাচে ভরতনাট্যম
বুকের গহীনে তাকে প্রাণভরে পেতে এই দু'হাত বাড়াই।

বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ, পাখির কুজন নাকি কেউ কেউ পায়
লাশের চৌদিক জুড়ে আমি শুধু শকুনের হর্ষধ্বনি শুনি
বুট ও বুলেট সহ জলপাই রঙের ট্রাক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে
এক দুই তিন করে সহস্র লাশের গন্ধ সংগোপনে গুনি।

কারু ঘরে ভাত নেই, কারু কারু ঘর নেই, চূড়ান্ত অভাব
বাতাসে কষ্টের ঘ্রাণ পশ্চিম ও ঈশানের কোণ থেকে আসে
কারু কারু ঘর থেকে সম্পদের ঘ্রাণ আসে, আমোদিত হাওয়া
প্রবল বাতাসে তবু ক্রন্দনের শব্দ আর হাহাকার ভাসে।

সুখের সৌরভমাখা মাটি ও শস্যের ঘ্রাণ, ফুলের সুবাস
উত্তরে ও পুবে নেই, দক্ষিণে কোথাও নেই নিশ্বাসের হাওয়া
কন্ঠনালি চেপে আছে লোমশ নৃশংস হাত , কালো এক হাত
এই হাত ছিঁড়ে ফেড়ে বিশুদ্ধ বাতাসটুকু হবে না কি পাওয়া?

আমাদের সন্তানেরা

আমাদের সন্তানেরা অনাহারে অপুষ্টিতে বেঁচে থাকে আজ।

দুগ্ধবতী গাভী ছিল, বিষাক্ত নাগিন এসে খেয়ে গেছে দুধ।
ঘরে ঘরে কালসাপ ছোবলের ফণা তুলে অপেক্ষায় আছে,
আমার সংসার খাবে, আমার সমাজ খাবে, প্রিয় দেশ খাবে।
এখনও এ দেশে নেই কোনও ওঝা, ও সাপের বিষদাঁত ভাঙে।
তালিম দেবে কে তবে? বিশুদ্ধ সাহস কার? কোন গুরুজন?
তার মস্তিস্কের ঘিলু খেয়ে গেছে ওই সাপ গোপন ঘাতক।

আমাদের সন্তানেরা করতলে ধরে আছে বিশীর্ণ জীবন,
প্রাপ্যটুকু নিয়ে গেছে, সুদিন পুড়িয়ে গেছে ভয়ানক চোর।
ঘরে ঘরে সেই চোর বাড়িয়ে দিয়েছে হাত, সর্বনাশা হাত।
সুখের জীবন নেবে, সমস্ত সুনিদ্রা নেবে, রক্তমাংস নেবে-
এখনও এ দেশে নেই এমন মানুষ কেউ চোরটাকে ধরে
তালিম দেবে কে তবে? বিশুদ্ধ সাহস কার? কোন গুরুজন?
তার মস্তিস্কের ঘিলু নিয়ে গেছে ওই চোর, গোপন ঘাতক।

মিছিল ১

চতুর্দিকে মানুষ এখন খেপে গেছে,
যখন তখন সবাই তারা মিছিল করে।
বিনা দ্বিধায় রক্ত ঢালে পিচের পথে
মৃত্যু দিতে এটতুকু প্রাণ কাঁপে না।

তবু কেন বাগান জুড়ে ফুল ফোটে না?
বুকের কাছে সাপের ফণা থমকে থাকে।
তবু কেন দেশটা ঘিরে বাঁদর নাচে?
ধিন ধিনা ধিন গদির নেশায় শিয়াল নাচে;
ধূর্ত শিয়াল, মাতাল শিয়াল, লোভে মত্ত বন্য শিয়াল
ধরতে গেলে ফসকে যায়-
হায়রে বাঁদর, মূর্খ বাঁদর
কলায় পোষা বেভুল বাঁদর নিরবধি তেল মাখে তাই,
ধরতে গেলে শিয়ালবাবুর তেলের শরীর ফসকে যায়-

মধ্যি থেকে মানুষগুলো ক্ষুধায় মরে
মধ্যি থেকে মানুষগুলো বঞ্চিত হয় প্রাপ্য থেকে।

তাই তো এমন খাঁ খাঁ করে শুকনো জীবন
তাই তো এমন হু হু করে শূন্য হৃদয়

বাগান জুড়ে ক্রিসেনথিমাম আর ফোটে না
আকাশ ভরে পায়রাগুলো আর ওড়ে না

রাত্রি এলে মেঘের ফাঁকে চাঁদ হাসে না।
যখন তখন মানুষ কেবল মিছিল করে,
দিন রাত্রি মানুষ শুধু

নতুন দিনের স্বপ্ন দ্যাখে,
সুখের শোভন স্বপ্ন দ্যাখে।

মিছিল ২

রক্তে ভেজা মানুষগুলো ওই তো আসে
বুলেটবিদ্ধ মানুষগুলো ওই তো আসে
হাত পা বাঁধা নির্যাতিত ওই তো আসে
বুটের লাথি খাওয়া মানুষ ওই তো আসে।

ওরা এসে মেঘটা ভেঙে সূর্য এনে রাত্রি জুড়ে সকাল দেবে
ওরা এসে মুখোশ ছিঁড়ে দেখাবে সব বিকৃত মুখ
ওরা এসে তুমুল জোরে ভাঙবে এবার শ্রেণীর বিভেদ
সমান সমান ভাগ বাটোরার হিসেব নিয়ে আসছে ওরা।

সময় এখন তটস্থ হও
বিত্তের উপর বিলাসী ঘুম তটস্থ হও
স্বার্থ নিয়ে নিশ্চিত সুখ তটস্থ হও
ভ্রান্তিগুলো গুটিয়ে রেখে তটস্থ হও।

বিশাল মিছিল আসছে দ্যাখো
রুখবে এত শক্তি কোথায়?

মিছিল ৩
: বাড়িতে তোমার কে কে আছে?
: অসুস্থ পিতার পাশে একখানা মাতা
গোটা ছয় ভাইবোন।
: গোয়ালের গরু?
: নেই।
: জমিজমা?
: তা-ও নেই।
: ভরপেট খেতে জানো?
: ভরপেট? সে আবার কোন ব্যামো?
: পথের মিছিলে যাবে? বিশাল মিছিল?
: মিছিল আমাকে কি দেবে? ভাত দেবে? পিতার ওষুধ?
: দেবে।

মিছিলে সবার আছে
দু'বেলা ভাতের দাবি।
সুখ ও সুস্থতা নিয়ে
রাত্তিরে ঘুমের দাবি।

বিশ্বাসের হাত

আমি ডানে না,বামে না। আমি আছি আমার মাটিতে।

ধর্ম নয়,কর্মযোগ্য মানুষের শৃঙ্খলিত ভিড় চাই
হত্যা নয়,সত্যান্বেষী মানুষের শুচিস্নিগ্ধ মুখ চাই।

আমার মাটিতে আমি মাটিযোগ্য শিল্পরীতি চাই।
আমার মাটিতে আমি মাটিযোগ্য রাজনীতি চাই।
ডানে না বামে না আমি, আমি আছি আমার মাটিতে।

অস্ত্র নয়, বস্ত্র চাই মানুষের উলঙ্গ শরীরে
ক্ষুধা নয়, সুধা চাই মানুষের বিশীর্ণ হৃদয়ে
বাদ্য নয়, খাদ্য চাই অভাবের মলিন কুটিরে

আমার মাটিতে আমি বাসযোগ্য ঘর চাই
আয়ুঅব্দি জীবনের নিশ্চয়তা চাই।
ভিক্ষা নয়, শিক্ষা চাই উপদ্রুত অনাথ জীবনে
দুঃস্থ নয়, সুস্থ শিশু চাই প্রতি নির্যাতিত ঘরে।

আমার মাটিতে আমি শোষকের রক্ত ঢেলে
সরাব বিষাদ,
পর্যাপ্ত রোদ্দুরে তাই মেলেছি দু'হাত
এই হাতে পেতে চাই লক্ষকোটি বিশ্বাসের হাত।

তবু যাব

আমি যাব
আমাকে ডাকছে রাজপথের মিছিল।

শরীরের পথ বেয়ে ছুটবে নৃশংস জলপাইরঙের ট্রাক
খাকি বেইমানগুলো টার্গেট প্রাক্টিস করে যাবে বুক বরাবর
বেয়নেটে হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে ফুঁড়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটবে ভীষণ-
তবু যাব
আমাকে ডাকছে প্রতিবাদের মিছিল।

ছিটানো আগুন-জলে খসে যাবে তামাটে চামড়া
আমাদের কন্ঠনালি কেটে ছুড়ে দেবে তারা নোংরা নর্দমায়
চোখ ও হাত পা বেঁধে ঠেলে দেয়া হবে অন্ধকূপে
লাশ গুম হবে, অগুনতি লাশ
বিনাশের হত্যাযজ্ঞ শেষে।

তবু যাব।
আমাকে ডাকছে ওই বিক্ষোভের শাণিত মিছিল।

অনাগত সুন্দর

মিছিলে বাড়ছে লোক, বিত্তহীনের মিছিল তাতানো দুপুরে
তৃতীয় বিশ্বের মাঠে, খেতে ও খামারে ভিড়, কৃষকের ভিড়
কলে ও কারখানায়, পিচের রাস্তায় ভিড়, শ্রমিকের ভিড়
মিছিলে নেমেছে সব হাভাতে বেকার আর ব্রোথেলের মেয়ে
পথের ভিখারি আছে, অনাথ শিশুরা আছে রোগক্লিষ্ট দেহ
সহস্র উদ্বাস্তু আছে,ছিচকে সিঁদেল চোর, চৌকিদার আছে
মাঝি ও জেলেরা আছে, ঘাটের কুলিরা আছে, মুটে ও মজুর
তাদের চোখের তারা আগুনের মতো জ্বলে, ক্ষুধার আগুনে
সকলে একত্র হয়ে সুতীব্র হুংকার দিলে আচমকা তবে
পৃথিবীতে ভূমিকম্প এসে অকস্মাৎ সব ভাঙবে প্রাসাদ
গুটিকয় বিত্তবান ইঁদুরের মতো ছুটে কোথায় লুকোবে
আয়েশে আরামে যারা গদিতে ঘুমায় গুনে অঢেল সম্পদ।

মিছিলে বাড়ছে লোক বিত্তহীনের মিছিল তাতানো দুপুরে
তাদের শরীর জুড়ে ঘাম ও রক্তের ঘ্রাণ, প্রাণেতে বিশ্বাস
গুটিকয় অত্যাচারী তেলে ও ভুঁড়িতে ঠাসা বেঢপ শরীর
পালাবার পথ নেই মুখোমুখি করজোড়ে মাগবে জীবন
সকলে একত্র হয়ে অস্ত্র উঠালেই ভয়ে মরবে পলকে
গুটিকয় স্বার্থপর, সুবিধাভোগীর দল, মহাজন প্রভু।

বিত্তের বন্টন হবে সুষম সুন্দর জুড়ে শান্তির ভুবন
শ্রেণীহীন সমতার পৃথিবী গড়বে তারা আসছে মিছিল
মিছিলে বাড়ছে লোক, বিত্তহীনের মিছিল, তাতানো দুপুরে।

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩

- কীসের নেশায় আজ লক্ষ লক্ষ ছাত্ররা নেমেছে
বিক্ষোভ মিছিলে? কেন? ব্যাক্তিগত কোনও লাভ লোভ?
গাড়ি-বাড়ি টাকাকড়ি পাবে কেউ? স্বার্থ আছে কারও?
লক্ষ লক্ষ প্রতিবাদী তরুণেরা এ মাটির গান গেয়ে বাঁচে।
কত তরতাজা ফুল ফুটেছে যে প্রথম ফাগুনে!

বায়ান্নোতে তবু ছিল ভিন্ন ভাষা ভিনদেশি রাজা।
ভাষা নিয়ে স্বভাষীর সাথে যুদ্ধ কে কবে শুনেছে?
কুশিক্ষার অন্ধকারে ছেয়ে যাবে স্বাধীন স্বদেশ
রুখব অন্যায় আজ সবে মিলে দেব না দেব না
বাঙালির মেরুদন্ড ভেঙেচুরে অচল বানাতে।

- অর্ডার অর্ডার
গুলি চালো।

হুকুম তামিল করো। শালা সব শুয়োরের দল
দুঃসাহস কত বড়, অপমান আমাকে করেছে!
এত বড় এই আমি, মাথাখানি আকাশে ছুঁয়েছে
নড়ে না চড়ে না তারা, করে যদি চাদ্দিক ঘেরাও?
বেজন্মা ছাত্রের দল, এত সোজা আমাকে হটানো?
সাম্রাজ্যবাদের সাপ, দুগ্ধপোষ্য কালসাপ আমি
বিষ আছে, বিষ আছে আহা বাপু ছোবল দেখনি।

অর্ডার অর্ডার
গুলি চালো।

গুলিতে ঝাঁঝরা করো বুক মেলে দাঁড়ানো ছাত্রকে।
স্লোগানে ফেরাবে তারা শিক্ষানীতি, দুঃসাহস দেখো!
নীতিকে ফেরানো যায়? আরে বাপু নীতি তো নীতিই!
অস্ত্রের অভাব নেই। ষড়যন্ত্র? কী নেই আমার?
দুর্নীতি উচ্ছেদ করে চালিয়েছি নীতি নীতি খেলা
গর্দভ বাঙালি বোবা বনে যাবে। আহারে বাঙালি!
লাগাও বুটের লাথি, মারো লাঠি আল্লাহর নামে
মাথা লক্ষ্য করে ঠিক, যেন মরে, যেন রক্ত ঝরে
আহা রক্ত রক্ত খেলা কতদিন কোথাও দেখিনি!
কী সুন্দর টকটকে লাল রং ঢাকার মাটিতে
সারা দেশ জুড়ে আমি এরকম মাটিই বানাব

অর্ডার অর্ডার
গুলি চালো।

মনভুলানো কথা তো ঢের বলি, কবিতাও লিখি
রাজা-বাদশা করে তো পাপটাপ কবিরা করে না।
তবু কিনা বাঙালিরা বেপরোয়া নাচতে নেমেছে?
যুদ্ধবাজ ছেলেপেলে কখনই বা কোথায় জন্মাল?
মুক্তিযুদ্ধ শিখিয়েছে কোন ব্যাটা? মরেছে পচেছে
যুদ্ধের ব্যারামে দেশ। তবু কিনা জীবাণু মরেনি?
(মুক্তিযুদ্ধ কাকে বলে ত'বা ত'বা জীবনে দেখিনি)
আমাকে প্রণাম করো, আমি রাজা। মাথা নত করো।
আমি খোদ খোদাতালা, নতজানু সেজদা শেখোনি?

অর্ডার অর্ডার...

- আমাদের পথরোধ করে কারা দাঁড়িয়েছে ওরা
ফিরব না। ফিরব না। আছে এই বুকেতে বিশ্বাস
ভালবাসা একমাত্র অস্ত্র আছে। ফিরব না আজ
রক্ত নেবে কত রক্ত? নেবে নাও। রক্ত আরও দেব।
বাঙালি হয়েছ ভাল, বাঙালির ইতিহাস জানো?
চৌদ্দ দল একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে বলেছে
আমরা যাবই যাব। পথ ছাড়ো, খেপিয়ে তুলো না।
ওইখানে সিংহাসনে বসে আছে যে রাজাধিরাজ
তার কাছে সোজাসুজি বলে দেব এ নীতি মানি না।

ট্রিগারে রেখেছ হাত কেন বলো কীসের অন্যায়?
দ্রিম দ্রিম দ্রিম...

আরে এ কী হত্যাকাণ্ড চারদিকে জুলুম জখম
আমরা কি জানোয়ার? নেড়িকুত্তা? শিয়াল শূকর?

- কেমন দেখলে বাছা ক্ষমতার জাদুকরী খেলা?
কেমন সেয়ানা আমি, হাড়েমাংসে খিচুড়ি বানাই।
গদিতে আরাম কত, এ আরাম এখনি ছাড়ব?
নীতির নামে দুর্নীতি চাপিয়েছি বাঘা বাঘা গুরু
এ নীতি ভাঙব কেন যত হোক তুমুল তাণ্ডব
বেলাজ ছাত্রের দল বেয়াদব মিছিলে নেমেছে
এদের নিশ্চিহ্ন করে শুদ্ধ করো তামাম জমিন।
মরছে মরুক, তাতে আমার কী? স্বজন তো নয়।
আমি ভাই বেশ আছি। সুস্থ দেহ রক্তারক্তি নেই।
আমাকে পাহারা দাও আমি যেন না মরি কখনও
এদের বিশ্বাস নেই। বাঙালি তো! রক্তেতে আগুন
আমাকে আড়ালে রাখো চুপিচুপি লুকিয়ে-টুকিয়ে
কখন উঠবে জ্বলে সর্বনাশা আগুন! আগুন!

আমি কি সেয়ানা কম? কথা বলে বাঙালি ভুলাব।
সহজ সরল মন যা যা বলি মাথা পেতে নেবে
বজ্জাত ছাত্রেরা কেন রাজনীতি শিখল আবার
কানে তুলো পিঠে কুলো বেঁধে ছাত্র পড়া শিখে যাবে
জাহান্নামে যাক দেশ, তাদের কী? মাথাব্যথা কেন?
যত নেতা আছে দেশে পুরে রাখো বদ্ধ কারাগারে
কী করে গজায় দেখি রাজনীতি মূল ছিঁড়ে নিলে
কী করে বিদ্রোহ আসে, কারা এসে আমাকে টলায়!

- এ কেমন মুক্তিযুদ্ধ দেশে আজ গণতন্ত্র নেই
এ কেমন স্বাধীনতা, বাঙালিরা শোষক সেজেছে?

কি শিক্ষা দিয়েছে বলো ইতিহাস এই কি নমুনা?
প্রতিকণা রক্ত থেকে একদিন জাগবে বিদ্রোহ
খুনের বদলা নেব সারা দেশে খেপেছে মানুষ
জান্নাতের দরোজায় লাথি মেরে জাগাব তোমাকে
পাবে না রেহাই তুমি, ক্ষমা তুমি পাবে না কখনও।

[sb]কাব্যগ্রন্থঃনির্বাসিত বাহিরে অন্তরে[/sb]

তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট

গতরাতে সেনাবাহিনীর এক গোপন বৈঠক থেকে জানা যায়
সৈন্যরা আর ব্যারাকে ফিরে যেতে চায় না
চারআনা সের ঘি
দু'আনা সের তেল
খেয়ে ওরা অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়।

শিক্ষা খাতে অভাব, শিক্ষকেরা মিছিল করছে
স্বাস্থ্য খাতে অভাব। চিকিৎসক মিছিল করছে
কৃষি খাতে অভাব, কৃষকেরা মিছিল করছে
কলে ও কারখানায় অভাব, শ্রমিকেরা মিছিল করছে।
চারদিকে অভাব
চারদিকে মিছিল,মিটিং, ধর্মঘট, অনশন।
সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্র
সেনাবাহিনীর হাতে বাজেটের আশি ভাগ।
এই সুখের মধ্যে
এই জবর দখলের প্রশান্তির মধ্যে
এই জবর দখলের প্রশান্তির মধ্যে
আশি ভাগের মধেয় কেউ ভাগ বসাতে চাইলেই
তার খুলি উড়ে যাবে
তার লাশ পড়ে থাকবে রাস্তায়, নর্দমায়।

আরো এক গোপন রিপোর্টে জানা যায়
গতরাতে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে
তিনি আশিষ করেছেন
বাছারা বড় হও
গায়ে গতরে ভুড়িসর্বস্ব হও
বিশ্বাসঘাতক হও
ব্যাংক লুঠ করো
বাড়ি গাড়ি করো
মানুষ হত্যা করো শহীদ মিনারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিছিলে।

কাব্যগ্রন্থঃবালিকার গোল্লাছুট ]

জয় বাংলা

বাংলা ভাষায় 'জয় বাংলা'র মতো প্রাণবান শব্দ আর নেই,
যে জিহ্বা 'জয় বাংলা' শব্দটি উচ্চারণ করে
সে জিহ্বা কোনও মিথ্যের সঙ্গে আপস করে না।

জয় বাংলা শব্দের শৌর্য ও সৌন্দর্য
পান করতে যে বাঙালি শেখেনি, ধিক তাকে
জয় বাংলার অন্তর্গত আগুনে
হিমগ্রস্ত গা সেঁকে নিতে যে বাঙালি পারেনি, ধিক তাকে।

যত পাখি আছে দেশে, যত নদী, যত ঘাসফুল
জন্মেছে দেশে, যত বৃক্ষ- সকলে বলেছিল একদিন 'জয় বাংলা'
সূর্যোদয় বলেছিল জয়
লোনা হাওয়া বলেছিল জয়
তুমি বলেছিলে, আমিও
আমাদের পূর্বপুরুষ বলেছিল জয় বাংলা।

এই জয় বাংলাকে জীবনের রক্তেমাংসে
যারা লালন করতে না জানে- তাদের, সেই দুর্ভাগাদের মৃত্যু হোক।



কাব্যগ্রন্থঃবেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা

ভঙ্গ বঙ্গদেশ

একটি দেশ ছিল সুজলা সুফলা
দেশের মানুষেরা সোনালি ধান যেমন হাওয়ায় দুলত,
তেমন দুলত নতুন পিঠেপুলির দিনে।
একটি দেশ ছিল শরতের মেঘ আকাশে মেলা বসালে সে-ও
বসাত মেলা সুখের, মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে
মাটিতে।

একটি দেশ ছিল আম-কাঁঠালের,
বর্ষার জলে কাকভেজা ঘরে ফিরে তিরতির কেঁপে উঠবার-
কুয়াশাকাটা রোদে গা পোহাবার দেশ।
একটি দেশ ছিল আমার, তার, আমাদের পূর্বপুরুষের।

এই ভালবাসাবাসির দেশটিকে হঠাৎ কারা যেন দু'টুকরো করে চলে গেল
যারা দু'টুকরো করল তারা দেশের, দেশের মানুষের
লাউয়ের ডগার মতো লকলকে স্বপ্নের গোড়া ধরে টান দিল
ঝাঁকুনি দিল দেশটির শেকড় ধরে- কে যে কোথায়
ছিটকে পড়ল, কে যে মরল কে যে বাঁচল তার হিসেব মিলল না।
দেখা গেল বিক্রমপুর থেকে গিয়ে পড়ল গড়িয়াহাটার মোড়ে
বর্ধমান থেকে কেউ ফুলতলি গ্রামে, যশোর থেকে কেউ গেল হাওড়ায়,
নেত্রকোণা থেকে রানাঘাটে, মুর্শিদাবাদ থেকে ময়মনসিংহে।
ভরা ফুলের বাগানে বুনো ষাঁড় ছেড়ে দিলে যা হয়, হল।
দু'টুকরো দেশ বাড়িয়ে আছে পরস্পরের দিকে তাদের
তৃষ্ণার্ত হাত, আর এই হাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে
মানুষেরই বানানো ধর্মের ক্লেদ, কাঁটাতার।

লজ্জা, ৭ ডিসেম্বর '৯২

কথা ছিল সতীপদ দাস সকালে আমার বাড়ি এসে
চা চানাচুর খাবে। দাবা খেলবে, চুটিয়ে আড্ডাও দেবে।
সতীপদ প্রতিদিন আসে, আজ আসেনি, খবর এল সতীপদর
বাড়ি ঢুকে একদল টুপি মাথার লোক
পেট্রল ঢেলে দিয়েছে ঘরের জিনিসপত্রে, টেবিল-চেয়ারে,
বিছানায়, আলমারিতে, বাসনপত্রে,
কাপড়চোপড়ে, বইয়ে।
তারপর ফস ফস করে কতগুলো ম্যাচের কাঠি জ্বেলে পেট্রল-ফেলা
জায়গায় ফেলেছে।
আগুন যখন লকলকিয়ে বাড়ছে সতীপদ উঠোনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে দেখছিল
কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে তাদের তাঁতিবাজার, তাঁতিবাজারের
এক টুকরো উদাস আকাশ।

সন্ধেয় সতীপদর বাড়ি গিয়ে দেখি
বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেয় ছাই আর কাঠকয়লার ওপর
সতীপদ বসে আছে একা, ওর গা গড়িয়ে নামছে
রক্ত, বুকে পিঠে কালশিরে দাগ।

ওকে আমি স্পর্শ করতে পারিনি লজ্জায়।

অকল্যাণ

কল্যাণীকে ধরে নিয়ে গেছে কে বা কারা, ঘরে
পড়ে আছে ছেঁড়া শাড়ি,
আলুথালু বিছানা বালিশ,
ভাঙা চুড়ি,
মেঝের রক্তের ফোঁটা, ক'জোড়া জুতোর দাগ, পোড়া সিগারেট
কল্যাণী হয়তো এরপর পড়ে
থাকবে জংলায়, অন্ধকারে, একা, ফুলে-ওঠা উলঙ্গ শরীর
শুঁকবে কুকুর ঝাড়জঙ্গলের, ঝাঁক বেঁধে
নামবে শকুন খেতে ঠুকরে ঠুকরে মাংস।
কল্যাণীকে দেখে লোকে মুখে চেপে রুমাল বলবে- আহা।
বলবে মেয়েটি বড় লক্ষ্মী মেয়ে ছিল, সাত চড়েও রা
করত না, বিষম লাজুক।

আর যদি ক্ষত, রক্তাক্ত, খুবলে নেওয়া
ছেঁড়া ছিন্ন শরীরে সে এসে
দাঁড়ায় ঘরের দরজায়, তার
শোকাকুল মা কি স্নেহে আর শুশ্রুষায় স্পর্শ করবে কন্যার
পুরুষ-ঘাঁটা গা?
অথবা আত্মীয়, প্রিয় পড়শি, বন্ধুরা? কেউ?

নাকি চোখের তারায় খেলা করবে কৌতুক,
কেউ মুখ টিপে হাসবে, বলবে কেউ
মেয়েটি অলক্ষ্মী ছিল, ছিল বেহায়াও খুব
বুকের কাপড়খানা যখন তখন সরে যেত বুক থেকে
ঠোঁট লাল করত সে পানে, অথবা হাসত
হেসে এমন গড়াত যে পুরুষ মানত না।
আর কারও তো এমন
হয় না কেবল তার বেলা এই হাল কেন
নষ্ট ছিল নিশ্চয় মেয়েটি।

কল্যাণী এখন নষ্ট বটে
আর যারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল
সে সুযোগ্য সন্তানেরা, তারা
আজ এই বিকলাঙ্গ দেশের সম্পদ।

বাড়ি যাবে, সুরঞ্জন?

তোমাদের ধোবাউড়া এখনও আগের মতো গ্রাম
সেই যে একটি চারা রোপেছিলে মাঠে, নীলাদ্রিদের বাগান ঘেঁষে, সেই চারা
বড় হতে হতে শেকড় ছড়িয়ে বড় এক বৃক্ষ হয়ে গেছে,
সোনালি ধানের গ্রাম, সোনালি আঁশের-
তোমাদের ধোবাউড়া
বাঁশঝাড়ের ভূতের ভয়ে সন্ধেয় ঘুমিয়ে পড়ে, এখনও সে
খুব ভোরে শিশিরকণার মতো খেলা করে সবুজ পাতায়, ফুলে

বাড়িটি আগের মতো আছে, গাছগুলো শরীরে বেড়েছে
সুপুরির বাগান, উঠোনে আম জাম লিচু কাঁঠালের সারি।
চুন-সুরকির আগের খিলান সেই
সেই কড়িকাঠ
শ্যাওলা জমেছে শুধু ঘাটলায়, নিকোনো উঠোনটিতে দুর্বা
তোমাদের বাড়ি, তোমার পিতার, পিতামহ, প্রপিতামহের বাড়ি
যাবে, সুরঞ্জন?

ঝিঁঝি ডাকে এখনও, এখনও ঝোপঝাড় থেকে হঠাৎ হঠাৎ
উঁকি দেয় ধাবমান হরিণের দ্যুতি
পাহাড় গড়িয়ে নামে আষাঢ়ের জল, ডালে বসে
কাক ভেজে, ভেজে উলঙ্গ শিশু, নদীতে ঝাঁপিয়ে খেলে,
মাছ ধরে, বাড়ি যাবে, সুরঞ্জন?

তোমার নিজের বাড়ি, কাঁঠালিচাঁপার ঘ্রাণ, চেনা পথ, হাডুডুর মাঠ
ছেলেবেলার ইস্কুল, যাবে?

কতকাল পরবাসে আছ,
এবার গঙ্গার জলে সব অভিমান ধুয়ে বাড়ি ফেরো, সুরঞ্জন।


কাব্যগ্রন্থঃআয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন দেব মেপে

সাতই মার্চ, ১৯৭১

একটি তর্জনী উঠেছিল সেদিন রেসকোর্সের মাঠে
সেই তর্জনীর প্রতি আমি নত হচ্ছি,
একটি গর্জন উঠেছিল সেদিন রেসকোর্সের মাঠে
সেই গর্জনের প্রতি নত হচ্হি আমি।

এখনও চোখের সামনে একটি দীর্ঘ মূর্তি দেখি,
মূর্তিটি লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের কথা বলে,
চেতনার জল মাটি পেয়ে সেই স্বপ্নে বেতস লতার মত বাড়ে।
এখনও একটি তর্জনী আমার সামনে উচু করা,
এখনও একটি গর্জন কানে বাজে -
আমি আন্দোলিত হই, আমি স্বপ্নবান হই।

স্বাধীনতা এখনও অর্জন হয়নি আমার,
পঁচিশে মার্চের রাতে যারা আমার মা'কে ধর্ষণ করেছিল,
তারা আজ আমাকে ধর্ষণ করবে বলে ঘিরে ধরেছে...

আরও একটি যুদ্ধ আমার প্রয়োজন।

মৃত্যুদণ্ড

এই আমি দাঁড়ালাম
শরীরে কোনও অসুখ আছে কি না পরীক্ষা করুন। শেষ স্নান করিয়ে দিন।
আখেরি ইচ্ছে-টিচ্ছের কথা জিজ্ঞেস করুন-
আপনারা তো এমন কথাই জিজ্ঞেস করবেন, কী আমার খেতে ইচ্ছে করে
বিরুই চালের ভাত? গলদা চিংড়ি? কই ভাজা? তেঁতুলের আচার? সর্ষেবাটা ইলিশ
কাকে দেখতে ইচ্ছে করে, বাবা মা? ভাই বা বন্ধু? খুব কাছের কোনও মানুষ?

না, এরকম কোনও ইচ্ছে আমার করবে না,
এসবের কিছুই না চেয়ে
আমি এমন একটি ইচ্ছের কথা বলব যে আমি জানি আপনারা চমকে উঠবেন।
আমি যদি বলি একটি সেকুলার পৃথিবী চাই, দেবেন?
অথবা যদি চাই শস্যখেতের সব আল ভেঙে যাক, কাঁটাতার সীমানা আর
দেশে দেশে দেয়াল ধসে যাক।
যদি চাই কোনও শ্রেণী নেই, নারী ও পুরুষে বৈষম্য নেই, ধর্ম নেই, দেবেন?
দেবেন তেমন একটি সুন্দর জগৎ আমার চোখের সামনে?

দিলে আমি হেসে ঝুলব ফাঁসিকাঠে
দিলে আমি মাথা পেতে নেব মৃত্যুদণ্ডাদেশ,
তা না হলে ফাঁসির দড়ি ছিঁড়ে আমি বেরিয়ে যাব, আবার বাঁচব।
বেঁচে আমি স্বপ্ন বপন করব একভাগ মাটি আর তিনভাগ জলে।

অস্বীকার

ভারতবর্ষ কোনও বাতিল কাগজ ছিল না যে তাকে ছিঁড়ে টুকরো করতে হবে।
সাতচল্লিশ শব্দটিকে আমি রবার দিয়ে মুছে ফেলতে চাই।
সাতচল্লিশের কালিকে আমি জল সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে চাই।
সাতচল্লিশ নামের কাঁটা গলায় বিঁধছে, এই কাঁটা আমি গিলতে চাই না,

উগরে দিতে চাই
উদ্ধার করতে চাই আমার পূর্বপুরুষের অখণ্ড মাটি।

আমি ব্রহ্মপুত্র যেমন চাই, সুবর্ণরেখাও চাই
সীতাকুণ্ড পাহাড় চাই, আবার কাঞ্চনজঙ্ঘাও চাই।
শ্রীমঙ্গল চাই, জলপাইগুড়িও।
শালবন বিহার চাই, আবার ইলোরা অজন্তাও।
কার্জন হল যদি আমার, ফোর্ট উইলিয়ামও আমার।
একাত্তরে যে মানুষ যুদ্ধ করে
জয়ী হয়,
দ্বিজাতি তত্ত্বকে ঠেঙিয়ে বিদেয় করে-
সাতচল্লিশের কাছে সে মানুষ পরাজিত হয় না কখনও।

ধর্মবাদ

ধর্মবাদীরা যেদিন ধ্বংস হবে, সেদিন ফিরব আমি ব্রহ্মপুত্র-পাড়ে।
তার আগে ঘোলা জলে আমি আঙুল অবধি ভেজাব না।
ধর্মবাদীরা যেদিন গুটিয়ে নেবে তাদের বাণিজ্য, সেদিন ফিরব আমি
ঘরে, তার আগে দুর্গম অরণ্য অঞ্চল ছেড়ে কোথাও যাব না।
সেদিন আমি নিশ্চিন্তে বারান্দায় চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে সূর্যোদয় দেখব।
সেদিন আমি গান গাইব গলা ছেড়ে , বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাব,
সেদিন এমনও হতে পারে কাউকে খুব মন দিয়ে আমি ভালও বাসব।
ধর্মবাদীরা ধ্বংস না হলে যদি আমি হাসতে চাই সে হাসি যেন কাষ্ঠহাসি হয়
যদি আমি গান গাইতে চাই আমার কন্ঠে যেন কোনও সুর না ওঠে...
মাটিতে বিষের বীজ বুনলে সে মাটি থেকে বিষবৃক্ষ গজাবেই।
ডাল পাতা পত্র পুষ্প কেটে তো আর বিষ দূর হয় না,
শেকড় ওপড়াতে হয়।
আজ ধর্ম তার ডাল পাতা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে
এই আফিমে আসক্তি বাড়ছে মানুষের।
মহামারি ঠেকাবে কে? আমি? তুমি? নাকি সে?

এমনও তো হতে পারে আমি তুমি সে মিলে আমরা একজোট হব, তারপর পাথর সরাব!

নির্বোধের দেশ

চুলের মুঠি ধরে দেশটিকে দু'বেলা আছাড় দিচ্ছে যারা
তারা এখন দেশের মাথা।
আর আমরা যারা দেশটির পোড়া ক্ষতে মলম লাগিয়ে দিই
আমরা যারা সবুজের মধ্যে লাল একটি সূর্য এনেছি পতাকায়,
আমরা যারা দেশটির দুঃখে রাতভর কাঁদি,
তারা দেশের কেউ হই না।

যারা দেশটির পিঠে চাবুক চালায়, পেশিতে জোর আছে বলে
মাঝেমধ্যে দেশটিও স্তাবক হয়ে পড়ে তাদের,
আর আমরা যারা রোগা, পলকা, না-খাওয়া, মাথার ওপর আকাশ নিয়ে বাঁচি,
দেশটিকে দুধ-কলা খাইয়ে মানুষ করি,
তারা নাকি ভালো লোক নই।

কবি নির্মলেন্দু গুণ

সারা দুপুর কমপিউটারকে প্রতিদ্বন্দী করে দাবা খেলছেন।
মানুষকে শতরঞ্চির অপর পারে বসাবার চেয়ে যন্ত্রকে বসানো বোধহয় ঢের নিরাপদ!
হবে হয়তো। তা না হলে তিনি কেন আজিমপুরের কবরখানার খুব কাছে বসে, এত কাছে যে
মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া যায়, সারা দুপুর বোড়ে চালাচ্ছেন, ঘোড়া হাতি রাজা মন্ত্রী চালাচ্ছেন!
কখনও কখনও কমপিউটারকেও তিনি হারিয়ে দেন।
অথচ বারবার হেরে যান রহিমুদ্দিনের কাছে, বদর আলির কাছে

আজকাল তিনি মদ এবং মেয়েমানুষে তেমন বিশ্বাসী নন
সন্ধেয় বসেন জুয়ো খেলতে, হাইড্রোজেন।
জুয়ো না খেললে তাঁর ভাল ঘুম হয় না, জুয়োতে না হারলেও
তাঁর অস্থির-অস্থির লাগে।
জুয়োতে দু'-চারশো টাকা হেরে গেলে তাঁর ক্রোধ হয় এক ধরনের
ক্রোধ হওয়াটাই চান তিনি।
ক্রোধ হলে দু'-একজনকে হারামজাদা বলে গাল দিতে পারেন।
বদর আলিরা তাঁকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নেত্রকোণা থেকে দুর্গাপুর ঠেলে দিচ্ছে
রহিমুদ্দিনেরা তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে পলাশি থেকে...
এদের তিনি প্রকাশ্যে রাস্তায় শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে
গুলিস্তানের মাথায় কিংবা প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচশো লোক শুনিয়ে
হারামজাদা বলে গাল দিতে চান, কিন্তু ভয়ে তাঁর গলার স্বর বুজে আসে।
তাই জুয়োর টেবিলে বসে একটি হারামজাদা গাল দেবার জন্য তিনি ইচ্ছে করেই হারেন
লোকে ভাবে এ বোধ হয় নিস্পন্দ তাসকে গাল দেওয়া, ইস্কাপনের বিবিকে
বা রুইতনের সাহেবকে।

নির্মলেন্দু গুণকে আমি বাংলাদেশ বলি,
বদর আলিদের কাছে সর্বস্ব হেরে
ছেঁড়া বালিশে মাথা রেখে পুলি কাঁথায় গা ঢেকে শুয়ে থাকে আমার বাংলাদেশ।

ব্লাসফেমি আইন

সংসদ ভবন থেকে সড়সড় করে নেমে এল একটি মস্ত অজগর
নগরের বড় রাস্তায় রাজার মতো চলল, ডানে গেল, বামে গেল
অলিগলি ঘুরল আর মানুষ খেল
যে মানুষ সত্য বলে, তাকে।
যে মানুষ সভ্যতা বলে, তাকে।
যে মানুষ নোংরা ঘাঁটে না, তাকে।
অজগরের খিদে মেটে না তবুও, সে এক নগর থেকে
আরেক নগরে গেল, বড় শহর থেকে ছোট শহরে,
সেখানেও তাজা মাংসের স্বাদ পেল-
যে মানুষ ছবি আঁকে,
যে মানুষ কবিতা লেখে,
যে মানুষ গান গায়।
অজগর বিষম খুশি। সে এঁকেবেঁকে নেচে নেচে
গঞ্জে গ্রামে নদী হাওড় খেত খামার পেরিয়ে আরও খাদ্য পেল-
যে কৃষক পাঁচবেলা লাঙল চালায়,
যে নারী মাঠে কাজ করে,
যে রাখাল বাঁশি বাজায়।
খেতে খেতে যখন পেট ভরল অজগরের
তখন আর মানুষ নেই দেশে, কিন্তু কেবল শ্বাপদ আছে
শ্বাপদ আর অজগরের বেশ ভাব হল, তারা দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বেঁচে থাকল।

বাবার কাছে চিঠি

বাবা, তুমি কেমন আছ?
এখনও কি আগের মতো মর্নিং ওয়াকে যাও ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে?
ব্রহ্মপুত্রে তো জল নেই, তুমি তবে কার দিকে তাকাও?
কাশফুল? কাশফুলও তো আজকাল তেমন ফোটে না।
তবে কি মানুষ দেখ, মানুষের ঢল নামে যে সার্কিট হাউসের মাঠে
সেই মানুষ?
মানুষেরা কি এখন আর তোমার দিকে এগিয়ে আসে আগের মতো,
চেনা মানুষ? বন্ধুরা? অথবা দু'-চারজন পড়শি?
নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেবার অপরাধে তোমাকে হাঁটতে হয়
মাথা নিচু করে গাছগাছালির আড়ালে
মানুষের শ্যেন দৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে?
হয়তো আজকাল মর্নিং ওয়াকও ছাড়তে হয়েছে ভোরের হাওয়া খেতে
আসা মানুষগুলো তোমাকে আঙুল তুলে শাসায় বলে!

তোমার জন্য আমার বড় মায়া হয়,
বড় মায়া হয় আমার।
সেই ছোটবেলায়, জুতোর মচমচ শব্দ তুলে ঢুকতে যখন বাড়িতে
এক্কাদোক্কার দাগ মুছে দৌড়ে যেতাম পড়ার টেবিলে।
এখনও মনে আছে, একদিন চুলোর কাছে বসে কী একটা
রান্না শিখছিলাম বলে উঠোনে সজনে ডাঁটা ছিল, তা নিয়েই
তাড়া করেছিলে, যেন ঘরে যাই, পড়তে বসি। যেন মানুষ হই।
পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে দিনে সত্তর বার
তোমার 'ছাত্রানাম অধ্যয়নং তপঃ' মন্ত্র শুনতে শুনতে
মানুষ কতটুকু হয়েছি জানি না,
তবে এটুকু জানি দুর্যোগ এলে মিথ্যের খোপের মধ্যে যখন
তাবৎ লোকেরা লুকোয়,
তখন মেরুদণ্ড শক্ত করে বেশ দাঁড়াতে পারি একা,
সত্যগুলো জিভের আগুনে খইয়ের মতো ফোটে।

আর এ কারণেই আজ আমাকে লক্ষ মিথ্যুকেরা খুঁজছে
ফাঁসি দেবে বলে, আজ আমি হুলিয়া মাথায় নিয়ে
ছুটছি ঘোর অন্ধকারে, আলো নেই, বুঝলে বাবা এতটুকু আলো নেই কোথাও-
দেশ কি এভাবেই এরকম ভুতুড়ে অন্ধকারে ডুবে থাকবে, মানুষগুলো
খোপের ভেতর বোবা কালা অন্ধ- স্বপ্নহীন বেঁচে থাকবে দীর্ঘ আয়ু
আর খাদ্য আর তসবিহর গোটা আর লোভ আর মোহ-মাৎসর্য নিয়ে
তুমিও কি চোখের সামনে বোঝো যে আলো নেই?
তুমিও কি পায়ের তলায় বোঝো যে মাটি সরছে?
তুমিও কি হাতের কাছে বোঝো যে কোনও বন্ধুর কাঁধ নেই?
তুমিও কি মাথার ওপর বোঝো যে মেঘ জমছে?

এখনও কি নতুন বাজারের 'আরোগ্য বিতানে' বসো? রোগী দেখ?
গরিব রোগীরা বিনে পয়সায় চিকিৎসা নেয়?
এই যে তোমার উদার দরজা মানুষের সেবার জন্য খোলা
তুমি কি জীবনের শেষ বয়সে এসে পারো রোগীর নাড়ি দেখতে ঠিক ঠিক?
নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেবার অপরাধে
যারা তোমার মাথায় পাথর ছুঁড়ে মারে, তারা তোমার হাত
থেকে ছিনিয়ে নেয় রোগীর কবজি?
কেড়ে নেয় তোমার স্টেথেসকোপ? এক্সরে মেশিন? মাইক্রোস্কোপ?
স্কালপেল, ফরসেপ?
তুমি একা পড়ে থাকো, বড় একা, কপালের দু'পাশে দপদপ শিরাদুটো দু'হাতে চেপে!

তোমার জন্য বড় মায়া হয় আমার, বড় মায়া।
একটু একটু করে যখন মানুষ হয়ে উঠছি, রক্তে টগবগ করে ফুটছে
যেন মানুষ হই, তোমার সেই মন্ত্র
কোথায় সকালে ঘুম ভেঙে তুমি দেখবে গোলাপ যেমন পল্লবিত হয়,
তেমন অন্ধকার কেটে কেটে ফুটছি
আমি, দু'হাত ভরে আলো আনছি থোকা থোকা
তোমার জন্য আর বারো কোটি মানুষের জন্য।
তোমার তো ব্লাড প্রেশার বেশি,
নিজের চিকিৎসায় কখনও তোমার মন নেই,
জ্বরে গা পুড়ে গেলেও
টলতে টলতে চলে যাও রোগী দেখতে,
বিনে পয়সার রোগী।
নিজের রক্তবমি রেখে অন্যের অম্বল সারাও!
এই তোমাকেই আজ মাথা নত করে হাঁটতে হয় রাস্তায়,
দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ধর্মদ্রোহী কন্যার ফাঁসির দাবিতে
আমাদের বাড়ির দেয়ালেও কি, বাবা?
সেদিন ওরা তিন দফা ভাঙচুর করল আমাদের বাড়িতে, তোমার চেম্বারে
ওই ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে তোমার কি মনে হয়নি
ধর্ম বেচে খায় এরা, ধর্ম এদের মসনদে ওঠার মসৃণ সিঁড়ি।
ধর্ম কি তখন মনে হয়নি তোমার যে, এটি আসলে বেচে খাওয়ার
এটি কেবল বোকা বানাবার অন্ধ বানাবার বধির বানাবার একটি তেতোমিষ্ট ফল,
আফিম!
তোমার জন্য বড় মায়া হয় আমার, বড় মায়া।

কতদিন দেখা হয় না তোমার সঙ্গে, কত দীর্ঘদিন!
শেষ যখন দেখি, দেখে তোমাকে মনে হয়নি তুমি আগের সেই তুমি,
আগের সেই ঋজু শরীর আর নেই, আগের সেই গমগমে কন্ঠস্বর,
আগের সেই জুতোর মচমচ শব্দ, আগের সেই...
তুমি তো হেরেছ জীবনে অনেক, আমিও।
তুমি তোমার গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলে, চেয়েছিলে
ধানে পাটে শাকে সবজিতে বৃক্ষে ফলে ছেয়ে যাক
তোমার শখের গ্রাম, এত সবুজের স্বপ্ন তুমি
কী করে লালন করতে, তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে যতই
ওপরে উঠি, যতই উঠি কোনও শীর্ষের নাগাল পাই না এই কৌতুহলী আমিও।
বিনিময়ে ওই গ্রামের লোকেরাই তোমার মাথায় কুড়ুলের
কোপ বসাল।
আর আমার স্বপ্নের ওপর দেশসুদ্ধ মানুষ ফেলে দিচ্ছে মণ মণ পাথর,
গজারি কাঠ, হাতবোমা, আগুন, বিষাক্ত সাপ, ফাঁসির দড়ি,
কী ভীষণ তাণ্ডব চারদিকে তাই না?
একটি মানুষকে হত্যা করবে বলে লক্ষ লোক তাড়া করছে,
হন্যে হয়ে খুঁজছে-
তুমি কি ভয় পাচ্ছ, ব্লাড প্রেশার বাড়ছে?
না বাবা ভয় পেয়ো না, আমি ঠিক দাঁড়াবই
ওদের পাথর, বোমা, তলোয়ার, পিস্তলের সামনে
আমি অনড় দাঁড়িয়ে থাকব। এত অনড় দাঁড়াব যে
ওরা হয়তো ওদের অস্ত্র নিক্ষেপ করে
আমার দেহকে নির্মূল করবে, কিন্তু বিশ্বাস?
বিশ্বাস তো মরবে না, যা আমি ছড়িয়ে দিয়ে
গেছি হাজার মানুষের মধ্যে, তা মানুষ
গোপনে হলেও রোপণ করবে, ওতে জল দেবে,
আর চারা যদি বড় হতে হতে বৃক্ষ হয়,
মহীরূহ হয়, তবে জগতে কত কুড়ুল আছে
কে কোপ বসাবে ওদের গায়ে? না হয় বসাক
মরা বৃক্ষের আনাচ-কানাচ থেকে আবার বুঝি অঙ্কুরোদগম হয় না? হয়!

বাবা তুমি ভেঙো না, যেমন মেরুদণ্ড শক্ত করে
দাঁড়াতে শিখিয়েছিলে আমাকে, তেমন দাঁড়িয়ে থাকো,
আমরা হেরে গেছি বটে আজ, মানুষ আজ চাবুক
মারছে আমাদের পিঠে
একদিন দেখো তোমার গ্রামও ধানে পাটে শাকে সবজিতে
বৃক্ষে ফলে সমৃদ্ধ হবে,
একদিন দেখো আমার স্বপ্নগুলোও ডালপালা মেলে বিকশিত হবে,
বিত্ত নেই, মান নেই
আমাদের বুকের ভেতর নিষ্কলুষ স্বপ্ন ছাড়া আর আছে কী, বলো?


কাব্যগ্রন্থঃ নির্বাসিত নারীর কবিতা

তবু ফিরব

আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর, নেত্রকোণা,
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোলে, খরায়, বন্যায়,
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের
পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুন্নেসা, অপেক্ষা করো ইদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারির বইমেলা,
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে ক'ফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুরের বাড়ির টিনের চালে একবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।

ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড় - আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।



সোল নিলসন

ডালবি থেকে সোল নিলসন নামের এক মেয়ে মাসে দু'বার আমাকে দেখতে আসে,
ছ'ঘন্টা পথ পেরিয়ে, ট্রেনে।
মেয়েটি সঙ্গে করে নিয়ে আসে পাঁপড়, কাজুবাদাম, তেঁতুল, আমের আচার, রসগোল্লার
রেসিপি,
ভাবে, এগুলো আমাকে দেশের স্বাদ বা গন্ধ কিছু হলেও দেবে।

মেয়েটি আমার কাপড়-চোপড়, বইপত্র, থাল-বাসন গুছিয়ে,
ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালিয়ে সাফ করে সিগারেটের ছাই ফেলা মেঝে, সন্ধে হবার আগেই
জানালায়
সাজিয়ে রাহে মোমবাতি।
দৌড়ে যায় কনসামে, ফুল কেনে, কেনে ঝুড়ি ভরে মাছ মাংস প্যাপ্রিকা কমলালেবু
ইত্যাদি,
রেঁধে বেড়ে- খেতে ডাকে, ব্যাস্ত টেবিলে ঘন ঘন চা দেয়,
মেয়েটি অনেকটা মায়ের মতো।

আমার মা উড়োজাহাজের শব্দ শুনলে আকাশে তাকিয়ে ভাবেন আমি ফিরছি দেশে,
আমার দুঃখিনী মা গুছিয়ে রাখেন দেশে ফেলে আসা আমার ঘরদোর বিছানা বালিশ।
জল গড়াতে গড়াতে তাঁর চোখের নীচে ঘা হচ্ছে-
একদিন সত্যিই যখন ফিরে যাব দেশে,
ডালবির বরফ ছাওয়া পথে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদবে সোল নিলসন,
আমার স্মৃতিগুলোই তাকে দু'বেলা গুছোতে হবে,
একদিন সেও আকাশে উড়োজাহাজের শব্দ শুনে ভাববে ওই বুঝি আমি!

দেশ বলে আসলে কিছু থাকতে নেই কারও।
মানুষের হৃদয়ই হতে পারে এক একটি নিরাপদ স্বদেশ।
আমার মায়ের আঁচল থেকে যেমন দেশ দেশ গন্ধ ভেসে আসে, সোল নিলসনের জামা
থেকেও।


আমাকে নিষ্কৃতি দাও

সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা, আমাকে এবার নিষ্কৃতি দাও
ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে শম্ভুগঞ্জ, তার দক্ষিণে সোয়া মাইল হেঁটে একটি
জামগাছতলা, পেছনে কুঁড়েঘর, ওখানে যাব আমি। ওটিই পার্বতীদের বাড়ি।
পার্বতী কে জানো? দু'বেলা ভাত ফোটে না চুলোয়, ফুটো চাল চুইয়ে বর্ষার জল
নামে যার ঘরে,
আমাকে নিষ্কৃতি দাও নিউ ক্যাসেল, নটিংহাম, বেলফাস্ট,
নিষ্কৃতি দাও ব্রাসেলস, বন, ড্রেসডেন, মিউনিখ,
আমি আর বক্তৃতা করতে চাই না তোমাদের উঁচু উঁচু মঞ্চে, মানুষের হাততালি
ফুলের তোড়ায় আমার মোটে শখ নেই,
আমাকে ক্ষমা করো চার্লস ব্রিজ, ক্ষমা করো কুকসহেভেনের পাব, ক্ষমা করো
ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট-

স্বপ্নের চারাগাছে পার্বতী আর জল ঢালে না, আমি যাব পার্বতীদের বাড়ি
আমার তো জল আছে, চোখে।

বার্লিনের চাঁদ

এ যেন ঠিক পুকুরপাড়ের
হাসনুহেনা গাছের ধারের চাঁদ।
ফুলবাড়িয়ায় যেতে যে বাঁশঝাড়, সেই ঝাড়ের
দিকে পা বাড়ালেও ঘাড়ের ওপর হেলে পড়বে ঠিক এরকম চাঁদ।

বার্লিনের এই মাটি শুঁকলে গন্ধ আসে পচা মাংস-হাড়ের
স্মৃতিগুলো হিটলারের
এখানে কিছু এখানে কিছু, মনে ও মস্তিষ্কে কিছু। কল-কারখানার ধোঁয়া,
আকাশছোঁয়া
ভাঙা গির্জা, নতুন দালান - সব ডিঙিয়ে চাঁদ উঠেছে।
এ যেন ঠিক বড়ুয়াদের পোড়োবাড়ির চাঁদ
দিনের বেলা মাছ কুটেছে
বঁটির মতো বঁটি আছে, আঁশগুলোও পাশে, কিশোরীরা চাঁদের জলে গা ধুতে যায়
মধ্যরাতে ছাতে।
এ যেন ঠিক আমলাপাড়ার পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা পাড়ার সুশান্তদার
হাসি, লোকে বলত সুশান্তদা পাগল!
ধুর, পাগল বুঝি বাজায় এমন পাগল করা বাঁশি?

চাঁদের কোনও পুব-পশ্চিম নেই, আকাশ তার উঠোন-মতো
কেবল মানুষেরই যত
মন্দভালর সাদাকালোর ওপার-এপার।
চাঁদ আসলে তার, যার হৃদয় ভরা আলো আর অঙ্গ গাঢ় আঁধার।

ঘরের দীর্ঘবাদনে হরিপ্রসাদের বাঁশি

তার অপেক্ষা করতে করতে আমার রান্না হয় না, স্নান হয় না, কাপড় ধোয়ার
বাঁধা সময় পার হয়ে যায়-
দুর্ভিক্ষের ভিখিরি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাতের থালায়
তেমন আমিও পড়ি দরজায়, টেলিফোনে; যদি বাজে।

রাজ্যির লোকের স্বর সারাদিন, কেবল তারই নেই,
কেবল তারই একা বাণিজ্য-ব্যস্ততা, অন্যত্র সঙ্গম।
অপেক্ষা করতে করতে রাত কাটে
না ঘুমিয়ে, ভিড়ের রাস্তায় হাঁটলেও মনে হয় একা, কোনও অরণ্যে।
তাকে না পেয়ে ক্ষয়রোগ বাড়ে, লাফিয়ে বাড়ে বয়স।

গুমরে কাঁদি খালি ঘরে, বিষাদে বিভুঁই-এ, তবু কী এমন কাঁদি আর, আমার চেয়ে
দ্বিগুণ কাঁদে হরিপ্রসাদের বাঁশি।

অভিমান

কেউ জানে না
জীবন ঝরে যায় বার্চের পাতার মতো,
আর পায়ে মাড়িয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যায়, পেছন ফেরে না, শরীরে জমতে
থাকে বরফের চাঁই, পাথর।

চিৎপুরে কিংবা আরমানিটোলার গলি হলে কেউ নিশ্চয় আহা বলত
পলাশির রাস্তায় ভিড় হত, গাড়িঘোড়া শ্লথ হত শ্যামবাজারে, নীলক্ষেতে।
জীবন উড়ে যায় দুরন্ত সি-গালের মতো, কেউ জানে না কোথায়,
পেছনে কেউ হাত নাড়ে না, কেউ জল মোছে না আঁচলে বা শার্টের হাতায়,
কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে বলে না ফিরে এসো।

জীবন পড়ে থাকে ফুটপাতে শুকনো ফুলের মতো, সিগারেটের ফিলটারের মতো,
কাগজের ঠোঙার মতো,
পেছন ফেরে না কেউ, শরীরে জমতে থাকে শ্যাওলা, ব্যাঙের ছাতা।
ঝরে যেতে থাকি বার্চের পাতার মতো, পড়ে থাকি ঘোর অন্ধকারে
কে আর আলো জ্বেলে বলবে- বাঁচো!
এ তো আর বোলপুর নয়, বনানী বা বঙ্গবাজারের মোড় নয়।

রাতের লন্ডন

সারারাত তুমি কত কী দেখালে-
পিকাডেলি সার্কাস, বাকিংহাম প্যালেস, ট্রাফালগার স্কোয়ার,
আমার আসলে কিছুই হয়নি দেখা ঘাস আর ঘাসফুল ছাড়া।
সারারাত দেখালে টাওয়ার ব্রিজ, চায়না টাউন, হাউজ অব কমনস -
নিঃসঙ্গ আকাশ ছাড়া আমি আসলে দেখিনি কিছুই!

শহর ঘুমিয়ে যায়, জেগে থাকি সারারাত
উত্তরের সমুদ্র থেকে ঝড় বৃষ্টি কাঁধে হাওয়া আসে বিষম আর
সারারাত অপ্রকৃতিস্থ বালিকার মতো ভিজি টেমস নদীর জলে,
আসলে, কেউ বোঝে না, মনে মনে ভিজি আমি বহুদূরে রেখে আসা গহন ব্রহ্মপুত্রে।

'আইরিশ, ইন্ডিয়ান এন্ড ডগস আর নট এলাউড'

ডাবলিন শহরের পুব পশ্চিম ঘুরে,
রাস্তায় রেস্তোরাঁয় বাঁশি আর চমৎকার গান শুনে
মধ্যরাতে আমি, আমার এক আইরিশ বন্ধু, সাদা একটি কুকুর কোলে নিয়ে
যখন বাড়ি ফিরি, দেখি
এক ইংরেজ ভিখিরি এক টুকরো রুটির জন্য ফুটপাতে কাতরায়
পকেটে খুচরো যা পয়সা ছিল, দিয়ে মনে মনে বলি- আজকাল সূর্য অস্ত যায়
ভারতে, আয়ারল্যান্ডে, দক্ষিণ আফ্রিকায়
কুকুরেরও মায়া হয়, জিভে চাটে ভিখিরির ছেঁড়া জিনিস
আহ্লাদে আটখানা নিঃস্ব ইংরেজ কুণ্ডুলি পাকিয়ে প্রাণপণ আড়াল করে
পূর্বপুরুষের পাপ-
দেখে আমি বা আমার আইরিশ বন্ধু বা কুকুর কেউই বড় একটা অবাক হই না।

পরবাস ১

পরবাস তার সস্নেহ বরফে ঢেকে রাখে আমার ঘামাচির পিঠ
তবু এক বেয়াদব বাঙালি বেরিয়ে আসে
মাথা ফুঁড়ে, থই থই আগুন যেন সাদা মাঠে...

অন্তরে জোয়ার আর শরীরে ভাটার টান, বসে থাকি বল্টিকের পাড়ে একা,
জোয়ার-ভাটা নেই পৃথিবীতে এই এক আশ্চর্য সমুদ্র- নিশ্চল,
মরা-জলে জীবন ভেজালে জানি না কে কার বদলাবে স্বভাব।
বল্টিকের দোষ-গুণ একদিন আমাকেই হয়তো গ্রাস করে নেবে,
উথলে উঠবে জল মৃত-শিশু কোলে।

পরবাস ২

দেশ তুমি কেমন আছ?
কেমন আছ দেশ তুমি?
তুমি, দেশ, আছ কেমন?
আছ তুমি কেমন, দেশ?

আমার তো পরান পোড়ে তোমার জন্য, তোমার পোড়ে না?
আমার তো জীবন ফুরোয় তোমাকে ভেবে, আর তোমার?
আমি তো স্বপ্ন দেখে মরি, তুমি?

আমার ক্ষতগুলো, দুঃখগুলো
চোখের জলগুলো
গোপনে সামলে রাখি।
গোপনে সামলে রাখি উড়ো চুল, ফুল, দীর্ঘশ্বাস।

আমি ভাল নেই,
তুমি ভাল থেকো প্রিয় দেশ।

পরবাস ৩

একটি একটি করে দিন যায়,
একটি একটি করে মাস,
ফুল-পাতা ঝরে, পাখিরা লুকোয়
জীবন শুকিয়ে হয় নাশ।

পরবাস ৪

নিজ-দেশে পরবাসী,
আবার পরবাসেও পরবাসী
দেশ তবে কোথায় আমার?

সুজলা সুফলা দেশ!
আমি জানি, দেশ জানে, আমার অন্তরে সে-দেশ।


পরবাস ৫

সে বলে সে সুখে থাকে পরবাসে।
মাঝে মাঝে হাসে
উন্মাদের মতো, একে ওকে ভালবাসে,
বেসে শেকড় ছড়িয়ে দেয় ঘাসে।

ঘাসে কি শেকড় ডোবে, বোকা!
গভীরে না গিয়ে কখনও কি হয় শোঁকা
জীবনের ঘ্রাণ! পাথরে রোপণ করে স্বপ্নের চারা, জল ঢেলে চোখের
কখনও কি কোনওদিন কমেছে ছায়া, শোকের!

পরবাস ৬

কার দোষে কী দোষে
আমি আজ পরবাসে
জানি না উত্তর।
জানি শুধু জীবনের উতল নদীতে
ভরা বর্ষার মাসে
পড়েছে বিস্তর চর।


পরবাস ৭

সকলেরই দু'একজন আত্মীয়, সংসার, ঘরে ফেরা ইত্যাদি কিছু না কিছু থাকে
কেবল আমারই কিছু নেই, কেউ নেই,
কেবল আমারই খরায় ফাটা বুকে বেশরম পড়ে থাকে শূন্য কলস।

সকলেরই জল থাকে, দল থাকে, ফুল ফল থাকেই,
আমারই কিছু নেই, সমস্ত জীবন জুড়ে শুধু ধু ধু এক পরবাস ছাড়া।

মাছে ভাতে বাঙালি

ভাতমাছ নিয়ে আজকাল ঘন ঘন বসি খাবার টেবিলে
কবজি ডুবিয়ে ডাল নিই, মাখি; মাছি তাড়াবার মতো
বাঁ হাতখানা মাঝে মাঝে দুলে ওঠে স্ক্যানডিনেভিয়ার শীত-নিয়ন্ত্রিত ঘরে
পোকামাকড়ের বংশও নেই, তবু কী যেন তাড়াই মনে মনে,
দুঃখ?
মাছের মলিন টুকরো, সবজি, থালার কিনারের নুন
আর ঘন ঝোল মাখা ভাত থেকে সরতে চায় না মোটে হাত
ইচ্ছে করে সারাদিন ভাত নিয়ে মাখামাখি করি, খাই
খুব গোপনে কি বুঝি না আমি কেন সোনার চামচ ফেলে ভাতের স্বাদ গন্ধ এত চাই!
আসলে ভাত স্পর্শ করলে ভাত নয়, হাতের মুঠোয় থোকা থোকা বাংলাদেশ উঠে আসে।



মা, এবারের শীতে

শীত আসছে, উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে এখন লেপ রোদে দেবার সময়।
মা আমার লেপ-কম্বল রোদে দিচ্ছেন, ওশার লাগাচ্ছেন, কোলবালিশে তুলো
ভরছেন - উঠোনে তুলো ধুনছে ধুনরিরা...
শীত এলেই মা'র এমন দম না ফেলা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়।
এবারের শীতেও রোদে শুকোনো লেপ এনে বিছানায় গুছিয়ে রেখেছেন মা।
এবারের শীতেও আচারের বয়াম রোদে দিচ্ছেন,
এবারের শীতেও ভাপা পিঠে বানাবার হাঁড়ি ন্যাকড়া জোগাড় করছেন।
কার জন্য? কে আছে বাড়িতে যে কিনা সারা শীত লেপের তলায় গুটি মেরে, মনে
মনে চমৎকার চাঁদের আলোয়, অরণ্যে, কাঠখড় কুড়িয়ে আগুন তাপায়, আমি
ছাড়া!

কে আছে বাড়িতে যার জন্য মিনিট পর পর ধোঁয়া ওঠা চা, মুড়ি ভাজা, আর
দুপুর হতেই আম বা জলপাইয়ের আচার-
ভোরের খেজুর-রস আর পিঠেপুলি- কার জন্য!

এবারের শীতে আমি স্ক্যানডেনেভিয়ায়, বরফে আর অন্ধকারে ডুবে আছি
জানি, ফেরা হবে না আমার, মাও তো জানেন ফেরা হবে না, রোদ পড়া উঠোন
আর নকশি কাঁথায় ন্যাপথলিনের ঘ্রাণের ওপর পাশের বাড়ির বেড়াল এসে শোবে
এত জেনেও মা কেন রোদে দিচ্ছেন আমার কাঁথা-কাপড়, লেপ, কার্পাস তুলোর
বালিশ!
এত জেনেও মা কেন ডুকরে কেঁদে ওঠেন ফোনে, যখন আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত
থেকে সুখবর দিই- 'ভাল আছি'।

অবুঝ আমার মা, আঙুলের কড়ায় গোনেন দিন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন
অপেক্ষায়। আর আচমকা প্রশ্ন করেন 'কখন আসছ তুমি? তুমি তো ঘুমোবে
এখানে, তোমার বিছানায়, গল্প শুনতে শুনতে নন্দীবাড়ির ভূতের আর বনের কাঠুরের আর
ব্যাং রাজকুমারের আর...

মা কি আগামী শীতেও আমার জন্য আবার রোদে দেবেন লেপ-তোশক, আচারের
বয়াম,
আর দরজায় টোকা পড়লে বঁটিতে মাছ রেখেই দৌড়ে দেখবেন আমি কি না!

ভূমধ্যসাগরের সি-গাল

পৃথিবীতে সকলেরই নিজস্ব একটা নদী বা সমুদ্র থাকে,
আমার বাড়ির পাশে একটি নদী,
আর আমার দেশের দক্ষিণে একটি সমুদ্র এখনও আছে,
এখনও তারা ফুঁসে ওঠে, তেড়ে আসে, পোষ মানে
আর পোষ মানা জলে বর্ষায় বৈশাখে ঝাঁপিয়ে খেলে গ্রামের কিশোর।

ভূমধ্যসাগরে সি-গালের সাঁতার দেখতে দেখতে
আজকাল বড় পাখি হতে ইচ্ছে করে, ভাসতে ইচ্ছে করে জলে হাওয়ায়
ভাসতে ভাসতে একদিন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের কাদায় উপুড় হতে ইচ্ছে করে কাটা
ঘুড়ির মতো-
ভাসতে ভাসতে আমাদের গোলপুকুরপাড়ের বাড়ির কলতলায়
শিমুল তুলোর মতো একদিন।

সি-গাল, তোমার ডানায় করে নেবে আমাকে?
আমার একটি বড় চেনা সমুদ্র আছে ওইপারে
বড় চেনা একটি নদীও।
আমার একটি বড় চেনা জীবন আছে এক দেশে
একটি হৃদয় আমি ফেলে এসেছি ধু ধু মাঠে, আম-কাঁঠালের বনে, লিচুতলায়।
একটি হৃদয় আমি ফেলে এসেছি বস্তিতে ডোবায় ঘিঞ্জি গলিতে,
যেখানে কালো কালো শিশুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাকের থালায়,
যেখানে ঝাঁক ঝাঁক মানুষের বুকের ওপর ঝুঁকে থাকে নীল মৃত্যু,
যেহানে আবার দোলনচাঁপাও ফুটে ওঠে মড়ার খুলি থেকে।

সি-গাল, তোমার ডানায় করে একদিন খুব ভোরে, চুপ চুপ করে, কেউ জানবে না,
নেবে আমাকে ভূমধ্যসাগর থেকে আমার বঙ্গোপসাগরে একদিন?


বাড়ি ফিরব

অনেক তো হল, মুগ্ধ মানুষের দল হাততালি দিল
প্যারিসে, স্ট্রাসবুর্গে, মারসেইয়ে, নান্‌ত্‌-এ। মাথায় মুকুট পরা তো হল অনেক
অনেক তো হল লাল গালিচা সংবর্ধনা- জুরিখে, বার্নে, বারসেলোনায়।
রাজা মন্ত্রীর সাক্ষাৎ, সোনার মেডেল, গোল্ডেন বইয়ে সই,
ট্রল্ডহেইম, স্টাভাংগার, অসলো, স্টকহোম,
গোথেমবার্গে যত ফুল ফুটেছিল, তার সবটুকু ঘ্রাণ নেওয়া তো হলই
পাইক পেয়াদা আর বশংবদ ভৃত্য নিয়ে ঢের দেখা হল হেলসিংকি, প্রাগ, কারলোভি ভেরি,
ঢের পাওয়া হল হইচই, নগরীর চাবি, উপঢৌকন।
এবার বাড়ি ফিরব, নিখিলদা।

বাড়ির দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে উঠোনের কাক তাড়াতে তাড়াতে
নুন লংকা মেখে পান্তা খাব, খেয়ে তবক দেওয়া পান।
ধনেখালি শাড়ি পরে কাগজি লেবুর, কামিনী ফুলের, মাচার লাউয়ের, বকনা বাছুরের,
খলসে মাছের, পাঁচফোড়নের গল্প শোনাতে শোনাতে
মা আমার হাতপাখায় বাতাস করবে আর তাঁর গায়ের ঘাম থেকে
তীব্র ভেসে আসবে আমার জন্মের, শৈশবের, কৈশোরের গোল্লাছুটের ঘ্রাণ।
অনেক তো হল মহাসাগরে সাঁতার,
এবার গ্রামের পুকুরে ভরদুপুরে দুটো ডুব দেব,
নিখিলদা।

রং বদল

গাছগুলো সবুজ থেকে হলুদ হচ্ছে, হলুদ থেকে লাল
রং বদলে যাচ্ছে, এরপর পাতা ঝরবে,
ডুবে যাবে সাদা বরফে।
ন'তলার জানলা থেকে আমি অন্ধকার দেখব,
অন্ধকারে তারার মতো ফুটে থাকবে
জাহাজের, বাড়ি, গাড়ির, দোকানপাট আর ল্যাম্পোস্টের আলো।
এরকম আলো তো আমার দেশেও ফোটে, আকাশে।

আমার দেশ?
আমার কি নিজের কোনও দেশ আছে আদৌ? নিজের কোনও শহর বা গ্রাম?
নিজের কোনও ঘর? নিজের কোনও শরীর বা হৃদয়?
এই যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভাসছি,
এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে, এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে,
অথবা এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে
ভাসতে ভাসতে একদিন শেষরাতে অথবা মাঝদুপুরে কোথায় ভিড়বে আমার জীবন!

আমিও হঠাৎ হঠাৎ দেখি আমার ভেতরে যে এক দঙ্গল সবুজ, সবুজগুলো হলুদ
হচ্ছে, হলুদ থেকে লাল, রং বদলে যাচ্ছে, এরপর হু হু শূন্যতা আমাকে কামড়ে ধরবে,
ঝরে যাব, ডুবে যাব সাদা কাফনে,

তিন হাত গভীর গর্তে
স্ক্যানডিনেভিয়ার শীত আর কতটুকু কামড় বসায় গ্রীষ্মের বালিকাকে,
তারও চেয়ে বেশি দাঁত বুঝি আগুনের, যে পোড়ায় ভীষণ একা, একাকী আমাকে।

ইওরোপে তৃতীয় বিশ্বের মেয়ে

পানি এখানে ফুটিয়ে খেতে হয় না,
মশা, মাছি, ইঁদুর বা তেলাপোকা দেখতে হলে পোকামাকড়ের জাদুঘরে যেতে হয়।
সুইচ টিপলে কাপড়-চোপড় ধুয়ে শুকিয়ে বেরিয়ে আসে।
তবু বাড়ির জন্য মন কেমন করে আমার।

বোতাম টিপে টাকা চাইলে রাস্তার ব্যাংক থেকে সুড়সুড় নোট বেরিয়ে আসে
জন্মের, চরিত্রের নাড়িনক্ষত্রও পলকে দেখে নেওয়া যায়,
দোকানিও বসিয়ে রাখে না, যন্ত্রই পণ্যের গা থেকে দাম পড়ে বলে দেয়, কত।
দোকানের, হাসপাতালের, অফিস-আদালতের, বাসের, ট্রেনের দরজা আপনাতেই
খুলে যায় হেঁটে গেলে
আপেল বা কমলালেবু পিষে রস করবার দরকার হয় না, প্যাকেটেই রস থাকে,
প্যাকেটেই রান্না থাকে মাছ-মাংস, প্যাকেটেই সেদ্ধ থাকে সবজি।
তবু বাড়ির জন্য মন কেমন করে।

রাতবিরেতে রাস্তায় একা বেরোলে কেউ এসে গলার চেইন খুলে নেয় না,
ছুরি দেখিয়ে টাকা চায় না, মেয়ে দেখলে এক দঙ্গল ছোকরা লাগে না পেছনে
শিস বা টিটকিরি - কিছু না।
যখন খুশি ঘাসের ওপর শুয়ে থাকতে পারি, বাতাসের উলটোদিকে
দক্ষিণে উত্তরে পুবে পশ্চিমে দৌড়োতে পারি
প্রেমিকের কোমর জড়িয়ে হাঁটতে পারি, চুমু খেতে পারি গাঢ়।
তবু দেশের জন্য মন কেমন করে আমার।

মধ্যরাতের ফোন

মধ্যরাতের ফোন, তুমি বেজো না।
তোমাকে বালিশ দিচ্ছি, কাঁথা-কম্বল, ঘুমের ওষুধ দিচ্ছিম
তুমি ঘুমোও।
সারা শহর এখন মড়া কাঠ, আকাশও তারা নিবিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

তুমি বাজলে শিরদাঁড়া বেয়ে তাল তাল বরফ নেমে আমাকে পাথর করে রাখে,
কালবৈশাখীতে শীর্ণ খেজুরপাতা যেমন কাঁপে, তেমন কাঁপে
আমার সর্বাঙ্গ। নিমেষে পঙ্গপাল নেমে আসে আমার ধানদুব্বায়...
স্বজন বন্ধুহীন পড়ে আছি একা, দূর বরফের দেশে।
হঠাৎ হঠাৎ খবর আসে রাজনীতির কাদা-মাঠে আকাট মূর্খরা বিষম
দৌড়োচ্ছে, আর ফাঁক পেলেই উঠোনে মাঠে ধানখেতে বুনছে ধর্মের বীজ।
বস্তি উঠছে, গ্রাম ছেয়ে যাচ্ছে পতিতায়, পিরে, ভিক্ষুকে-

বাবার বুকের ব্যথাটি শুনেছি আজকাল আরও বেড়েছে, চোখেও কম দেখেন,
বন্ধুরা এক-একজন দুম করে কোথায় পালাচ্ছে কে জানে-
মধ্যরাতের ফোন, বেজো না। এত রাতে কেউ জেগে নেই,
রাতের মাতালগুলোও এক এক করে ঘুমিয়ে গেছে, তুমিও ঘুমোও।


ফেরাও

বল্টিক সমুদ্রের পাড়ে লাল একটি কাঠের বাড়ি
বাড়ির সামনে খোলা মাঠ, মাঠে বিস্তর চেরি, স্ট্রবেরি আর আপেলের গাছ।
পেকে একা একা পড়ে থাকে ঘাসে, হরিণ আসে মাঝে মধ্যে ঘাস খেতে
আর গাছের গায়ে গা চুলকোতে -
ম্যাগপাই পাখিরা আসে বেড়াতে বেড়াতে, কিছু নির্জন হাওয়াও,
সেই বাড়িতে অল্প অল্প করে একটি সংসার গড়ে উঠছে আমার, চাল ডাল নুনের সংসার -
বিকেলের চায়ে দু'চামচ নিঃসঙ্গতা গুলে পান করার সংসার,
সারারাত অরণ্যের অন্ধকারকে শিয়রে বসিয়ে আগুন তাপাতে তাপাতে
গল্প করার সংসার, আবার ভোরের দিকে ঘুম নামলে আড়মোড়া ভেঙে চনমনে হওয়ার
সংসার।

এখনও ফেরাও আমাকে।
এখনও আমাকে ধুলোবালি, নদী-হাওড়, সরষে খেত আর ব্রহ্মপুত্র দাও।
এখনও দাও কলতলা, নিকোনো উঠোন, হাতপাখার হাওয়া, টিনের চালের রিমঝিম, ব্যাঙ
আর
ঝিঁঝির ডাকের গোটা বর্ষা, ধোঁয়াওঠা ভাতে মাগুর মাছের ধনেপাতা ঝোল।
এখনও স্ক্যানডিনেভিয়ার শরীর থেকে সরিয়ে নাও আমার ছুঁই ছুঁই শেকড়,
আমাকে বাঁচাও।

এমন বাদল দিনে

দু'ফোঁটা বৃষ্টি ঝরলেই, আকাশ মেঘলা হলেই বাড়িতে ধুম পড়ত সুখের
সারাদিন হইহই রইরই, গল্প জমে উঠত ঠাকুরমার ঝুলির,
কেউ গলা ছেড়ে গাইত বর্ষার গান, কেউ কেউ বসে যেত গরম বাদাম, ঝালমুড়ি,
ধোঁয়া ওঠা চা, তাস কিংবা বাগাডুলি হাতে
কেউ আবার সুড়সুড় করে নেমে পড়ত উঠোনের বৃষ্টিতে -
ভুনো খিচুড়ি আর ভাজা ইলিশের গন্ধে ম-ম করত বাড়ি।

আর এখানে আকাশে মেঘ করলে লোকের মন খারাপ হয়
বৃষ্টি নামলে সকলে রাগ করে।
আমি বড় অবাক হই, বর্ষাকাল বলে কোনও কাল এদের নেই -
কালবৈশাখী নেই, আম কুড়োনো নেই, জলে ভিজে অসুখ করার সুখ - তাও নেই।
স্যাঁতস্যাঁতে সাদা ত্বক সারাদিন কাতর প্রার্থনা করে রোদ,
আমিই কেবল এই দূর ভিন দেশে কারও মনমর্জি তোয়াক্কা না করে
আকাশে মেঘ দেখলে রিমঝিম হেসে উঠি।

ব্যবচ্ছেদ

ওরা প্রথম আমার ঊরু কেটে নিল, একথাক মাংস ছাড়া কিছু নেই।
শিরা কাটল হাতের, পায়ের - স্রেফ ফিনকি ওঠা রক্ত।
চোখের মণি, ফুসফুস, পাকস্থলী টেনে বার করল, আগপাশতলা দেখল যকৃতের,
পিত্তথলির,
খাবলে তুলল জরায়ু- না কিছু নেই।
কিছু নেই মস্তিস্কে, শিরদাঁড়ায়, পিঠে, পেটে
দুটো বৃক্ক পড়ে ছিল উদাস দু'দিকে, খুলে মেলে ও দুটিও দেখা গেল ফাঁকা।

কিন্তু হৃৎপিণ্ডে হাত পড়তেই
হ্যাঁস হৃৎপিণ্ডে হাত পড়তেই স্পষ্ট বুঝল ওরা, কিছু আছে এতে।
ওরা দাঁতে-নখে ছিঁড়ল এটি, ছিঁড়ে ভেতরে একটি দেশ পেল, বাংলাদেশ।

কাব্যগ্রন্থঃজলপদ্য

চুনোপুঁটির জীবন

নদী থেকে ভেসে ভেসে কোথাকার খালে এসে
অন্ধকারে, সাপখোপের গা ঘেঁষে, ফেঁসে
জড়াল জালে।

যন্ত্রের জালে
হালে
বা কলিকালে
এমনই দূর্গতি কপালে
এমনই সংসার চুনোপুঁটির,
জাল থেকে আলগোছে শরীর সরানো যায়
যদি, মন সরে না চুনোপুঁটির।

দেশ বলতে এখন

দেশ এখন আমার কাছে আস্ত একটি শ্মশান,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে একটি কুকুর কাঁদে,
আর এক কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে থাকে চিতা জ্বালানোর ক'জন লোক।
দেশ এখন আমার কাছে আর শস্যের সবুজ খেত নয়,
স্রোতস্বিনী নদী নয়, রোদে ঝিলমিল দিঘি নয়,
ঘাস নয়, ঘাসফুল নয়...

দেশ ছিল মা'র ধনেখালি শাড়ির আঁচল
যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা, দরজায়।
দেশ ছিল মা'র গভীর কালো চোখ,
যে চোখ ডানা মেলে উড়ে বেড়াত রোদ্দুরে, রাত্তিরে
যেখানেই ভাসি, ডুবি, পাড় পাই- খুঁজত আমাকে।
দেশ ছিল মা'র এলোচুলের হাতখোঁপা,
ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত আমার।

দেশ ছিল মা'র হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি
মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনো খিচুড়ি
দেশ ছিল মা'র হাতের ছ'জোড়া রঙিন চুড়ি।
দেশ ছিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকার আনন্দ।
কনকনে শীতে মা'র কাঁথার তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া,
ভোরবেলায় শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল পিঠে খাওয়া

অন্ধকার মুড়ে,
দূরে,
নৈঃশব্দের তলে মাটি খুঁড়ে
দেশটিকে পুরে,
পালিয়েছে কারা যেন,
দেশ বলতে কেউ নেই এখন, কিছু নেই আমার।
খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর ক'জন নেশাগ্রস্ত লোক।

নির্মলেন্দু গুণ

মুখ চুন করে বসে আছেন নির্মলেন্দু গুণ,
এলে ফাল্গুন,
ইচ্ছে তার করেন দু'-একটি খুন
লোকে বলে এ গুণের দোষ, আমি বলি গুণ।

গুণ তো দেখছেন, দেশটিকে কুরে খাচ্ছে ঘুণ।

কাব্যগ্রন্থঃখালি খালি লাগে

বস্ত্রবালিকারা

বস্ত্রবালিকারা দল বেঁধে হাঁটছে
যেন এক ঝাঁক পাখি উড়ছে বাংলাদেশের আকাশে।

বস্ত্রবালিকারা দল বেঁধে গভীর রাত্তিরে বস্তিতে ফিরছে,
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত
বালিকাদের গুটিকয় টাকার দিকে হাত বাড়াচ্ছে
রাস্তার অকর্মা যুবক
বালিকাদের শরীরের দিকে শরীর বাড়াচ্ছে বখাটে মদাড়ু
বালিকাদের খোয়াতে হয় সব, যা আছে যা নেই সব।

রাতটুকু নিদ্রাহীন কাটিয়ে সূর্য ওঠার আগে
বালিকারা দল বেঁধে হাঁটে
দেখে শহরের তাবৎ ভদ্রলোকের জিভে লোল জমে
দেখে অতি ভদ্রলোকেরা থুতু ছিটোয়
বালিকাদের গায়ে
বালিকারা তবু হাঁটে, হেঁটে যায় -
কারও খায় না পরে না তারা হেঁটে যায়

বস্ত্রবালিকারা বাঁধা ধনীর শক্ত দড়িতে,
কলুর বলদের মতো ঘানি টানছে ধনীর। ধনীরা পাচ্ছে তেল, বালিকারা খাদ।
রংধনুর রং দেখা বালিকাদের হয় না কখনও।
ঘুরঘুট্টি অন্ধকার গায়ে মুড়ে তাদের ধর্ষণ করে বস্তির মাস্তান।
রুপসী চাঁদের জলে স্নান করা তাদের কখনও হয় না।

বস্ত্রবালিকারা দল বেঁধে হাঁটছে
যেন পৃথিবীর আকাশে উড়ছে এক ঝাঁক বাংলাদেশ।

(এই কবিতাটি তানভীর মোকাম্মেলের 'বস্ত্রবালিকা' নামের চলচ্চিত্রটির নির্মাণের বেশ কয়েক বছর আগে লেখা। 'বস্ত্রবালিকা' তসলিমা নাসরিনের নিজস্ব শব্দ, যেমন নির্মলেন্দু গুণের নিজস্ব শব্দ 'মুঠোফোন'। তানভীর মোকাম্মেল এই কবিতাটি থেকেই তাঁর চলচ্চিত্রের নামকরণ করেছিলেন।)

সাবলীল

আমি রাতকে রাত বলি, শর্বরী বলি না।
বলি না কারণ একুশ কোটি বাঙালি রাতকে রাত বলে,
শর্বরী বলে না।

কুয়াশা কুয়াশা করে ভালবাসার কথা, রেখে ঢেকে ঘৃণা
পোষাতে পারি না,
সশব্দে সজোরে যা বলার বলি, যা হয় হোক, রাস্তায় পড়ে
থাকবে লাশ থাকুক,
এসবে আর যে করে করুক, বাঙালিই পরোয়া করে না।
যে ভাষায় দুঃখ সুখের কথা বলে তারা
ভাব বা অভাবের কথা,
যে ভাষায় যুদ্ধ বা সংগ্রামের কথা বলে
যে ভাষায় শান্তি স্বস্তির কথা, সে ভাষায় বলি
সংগোপনে যে স্বপ্নটি একুশ কোটি বাঙালি দেখে, সে স্বপ্ন
আমিও দেখি।

আমি সুবিধাকে সুবিধা বলি, সৌকর্য বলি না
বলি না কারণ একুশ কোটি বাঙালি সুবিধাকে সুবিধা বলে, সৌকর্য বলে না।

মুঠোর মধ্যে আধুলি নিয়ে মুহূর্তে জগতের অধীশ্বর বনে
যেতে পারি,
সকল বৈভব ছেড়ে বৈরাগ্যসাধনে মগ্ন হতে।
সকল নিয়ে সর্বনাশের আশায় বসে থাকা, খড়কুটোর মতো
বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়া নির্মোহ জীবন
জীবন তো নয়, শুদ্ধ কবিতা,
একুশ কোটি বাঙালির জীবন একুশ কোটি কবিতা।

শুদ্ধ স্নিগ্ধ সহজ কবিতায় আমি মগ্ন নিমগ্ন
তাই কোমলকে কোমল বলি, শ্লক্ষ্ণ বলি না
বলি না কারণ একুশ কোটি বাঙালি কোমলকে কোমল বলে,
শ্লক্ষ্ণ বলে না।

বাহান্ন থেকে একাত্তর

চোখ মেলে প্রথম দেখে মুখ বাঁধা,
একদল কুচুটে লোক চোখ রাঙাচ্ছে, গাল দিচ্ছে
বাহান্নয় প্রথম তারা মুখের বাঁধন খুলে চিৎকার করেছে,
যেই না চিৎকার অমনি
লোমশ লোমশ থাবা ধরেছে গলা চেপে
এরপর তো চোখ মেলে দেখলই তারা বন্দি,
হাতে পায়ে শেকল
তবু শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়েছিল
শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছিল পথে, পথ ভেসে গেছে
বুকের রক্তে
সেই রক্তাক্ত পথই ছিল তাদের ঠিকানা।
একাত্তরে তারা চেতনার চূড়ান্ত শিখরে
একাত্তরে তারা যেমন হৃদয়বান, তেমন আগুন
একাত্তরে হিংস্র লোকের হিংস্রতা থেকে
মুক্ত করল নিজেদের
এরপর ধস

এরপর ধস নেমেছে একটি জাতির জীবনে
ক্ষুদ্র স্বার্থে নিমগ্ন এক-একটি হৃদয়বান মানুষ, এক-একটি
জ্যোতির্ময় আগুন,
এক-একটি সম্ভাবনার বিনাশ।
নিজেরাই নিজেদের পুড়িয়ে ছাই করেছে,
বাহান্ন থেকে একাত্তর, এই কুড়ি বছর যাপন করেই তারা
আবার আগের মতো বন্দি,
নিজেরাই নিজের পথ ভাসায় নিজেদের রক্তে।
নিজেদের শেকলে নিজেরা বাঁধা,
নিজেরাই কুলুপ এঁটেছে নিজেদের মুখে।
নিজেরাই নিজেদের চেতনার ঘরে ঢুকিয়েছে কালসাপ।

বৃষ্টিতে ভিজছে হৃদয়

টিনের চালে রিমঝিম শব্দ হলে ঝাঁপিয়ে নামতাম উঠোনে
ভিজতে ভিজতে ঝড়ে পড়া আম কুড়োতাম - সে
ছোটবেলায়।
বড়বেলায় বৃষ্টি হলে ঝাঁপিয়ে নামার কোনও উঠোন নেই
জানালায় একা বসে বৃষ্টিতে হৃদয় ভেজাই।
জল নয়, টুপটাপ স্মৃতি পড়ে
স্মৃতিতে ভাসতে থাকে জীবন, জীবনের নিকোনো উঠোন।
মনে মনে সে উঠোনে নেমে কড়া কড়া আম কুড়োনোর মতো
অগুনতি দুঃখ কুড়োই
কুড়োতে কুড়োতে দু'হাতে কুলোয় না, উপচে পড়ে আঁচল,
ভেজা হৃদয়।

সবাই, সবকিছু এখন স্মৃতি

যাদের সঙ্গে খোলা মাঠে গোলাপপদ্ম খেলেছি তারা এখন
স্মৃতি ছাড়া কিছু নয়
সবচেয়ে আপন যে বন্ধু ছিল, কথা ছিল চোখের আড়াল
হব না কেউ কারও,
ভরদুপুরের সন্ধের অন্ধকার আচমকা বাদুরের মতো ঝুলে
থাকে,
যখন সেই মুখটি মনে করি।

সেই মাঠ, সেই কড়ইতলা, ব্রহ্মপুত্র নদ, কাশফুলে ঢাকা
নদের ওপার - সবই স্মৃতি
লাল সাদা বাড়িগুলো, লিচুগাছগুলো, ভোরবেলা পাশের
বাড়ি থেকে ভেসে আসা
রবীন্দ্রসংগীত, কাঁঠালিচাপার ঘ্রাণ, সবই -
রাত জেগে গল্পগুলো স্মৃতি, সুখগুলো।
জীবনের তিনভাগ স্মৃতি নিয়ে যাপন করছি বাকি এক ভাগ।
এই এক ভাগে কিছু নেই, ফাঁকা, খাঁ খাঁ

কণিকার গানগুলি

বিষম মেতে থাকি এরিক ক্ল্যাপটনে
ব্লুজ, জ্যাজ, সোল, কান্ট্রি শেষ করে এসে রক এন রোলে।
ব্রুস স্প্রিন্সটিনের সঙ্গে গাইতে থাকি, নাচি
ট্রেসি চ্যাপম্যানে মন দিই,
ইদানীং কে কী গাইছে, কে কেমন এসব নিয়ে গড়াতে থাকি
ঝকমকে পাথর
গড়াতে গড়াতে শ্বাসকষ্ট হয়, রক্ত শীতল হতে থাকে পশ্চিমী হাওয়ায়,
আমাকে ফিরতে হয় রবীন্দ্রনাথে, কণিকার গানে,
গানগুলি আমাকে বাঁচায়।

কাব্যগ্রন্থঃকিছুক্ষণ থাকো

এসেছি অস্ত যেতে

পুবে তো জন্মেছিই, পুবেই তো নেচেছি, যৌবন দিয়েছি,
পুবে তো যা ঢালার, ঢেলেইছি
যখন কিছু নেই, যখন কাঁচাপাকা, যখন চোখে ছানি, ধূসর-ধূসর,
যখন খালি-খালি, যখন খাঁ খাঁ - এসেছি অস্ত যেতে পশ্চিমে।

অস্ত যেতে দাও অস্ত যেতে দাও দাও অস্ত যেতে
না দিলে স্পর্শ করো, একটু স্পর্শ করো, স্পর্শ করো একটুখানি
লোমকূপে বুকে
স্পর্শ করো ত্বকের মরচে তুলে ত্বকে, চুমু খাও,
কণ্ঠদেশ চেপে ধরো, মৃত্যুর ইচ্ছেটিকে মেরে ফেলো,
সাততলা থেকে ফেলো! স্বপ্ন দাও, বাঁচাও।

পুবের শাড়ির আঁচলটি বেঁধে রেখে পশ্চিমের ধুতির কোঁচায়
রং আনতে যাব আকাশপারে,
যাবে কেউ? পশ্চিম থেকে পুবে,
দক্ষিণ থেকে উত্তরে ঘুরে ঘুরে
এই তো যাচ্ছি আনতে উৎসবের রং, আর কারও ইচ্ছে থাকলে চলো,
কারও ইচ্ছে হলে আকাশদুটোকে মেলাতে, চলো।
মিলে গেলে অস্ত যাব না, ওই অখন্ড আকাশে আমি অস্ত যাব না,
কাঁটাতার তুলে নিয়ে গোলাপের বাগান করব, অস্ত যাব না,
ভালবাসার চাষ হবে এইপার থেকে ওইপার, দিগন্তপার
সাঁতরে সাঁতরে এক করে দেব গঙ্গা পদ্মা ব্রহ্মপুত্র, অস্ত যাব না।

কাব্যগ্রন্থঃবন্দিনী

কয়েক বছর

কয়েক বছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি
আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে
আছি কয়েক বছর।
কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কিনা,
কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যবধান কমে কমে
শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে।
কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে,
সে বীভৎস বোবা একটা মানুষ,
যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে,
জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত।
আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না,
শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও,
কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ,
সাদা কাগজের গায়ে সাদা রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ।

দেশ বলে কি কিছু থাকতে নেই আমার

এমনই অপরাধী, মানবতার এমনই শত্রু আমি,
এমনই কি দেশদ্রোহী যে দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার!
দেশই তবে কেড়ে নেবে আমার বাকিটা জীবন থেকে আমার স্বদেশ।

দেশ দেশ বলে অন্ধের মতো উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ
পাহাড় সমুদ্র আর সারি সারি বৃক্ষ
অন্ধের মতো আকাশ চাঁদ কুয়াশা রোদ্দুর
অন্ধের মতো ঘাস লতাগুল্ম মাটি আর মানুষ হাতড়ে হাতড়ে দেশ খুঁজছি।

পৃথিবী ফুরিয়ে অবশেষে জীবন ফুরোতে
দেশের তীরে এসে বসা ক্লান্ত পিপাসার্ত মানুষের নিশ্চিন্তিকে তুমি যদি
টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাও, আঁজলার জলটাও ছুঁড়ে দিয়ে
আমাকে মৃত্যুদণ্ড দাও, তবে কী নামে ডাকবো তোমাকে, দেশ?

বুটের ওপর মস্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে
বুটজুতোর পা দিয়ে গলা পিষছো, খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছো দু'টো চোখ,
মুখ থেকে টেনে বের করে নিয়েছো জিভ, টুকরো করেছো,
চাবুক মেরে চামড়া তুলে নিয়েছো,
গুঁড়ো করে দিয়েছো পা, পায়ের আঙুল, খুলি খুলে মস্তিষ্ক থেতলে দিচ্ছো,
বন্দি করেছো, যেন মরি, যেন মরে যাই,
আমি তবু দেশ বলেই তোমাকে ডাকি, বড় ভালোবেসে ডাকি।
কিছু সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমি দেশদ্রোহী,
মিথ্যুকের মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুমি চলবে বলে আজ আমি দেশদ্রোহী
মানবতাকে যেন মাটি দিয়ে দিই নয়তো সাত আসমানে উড়িয়ে দিই -
তর্জনী তুলে বলে দিয়েছো।
আর যা কিছুই থাক বা না থাক, দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার।
আমার জীবন থেকে, তুমি দেশ, হৃদয় খুঁড়ে নিয়ে গেলে আমারই স্বদেশ।

নো ম্যানস ল্যান্ড

নিজের দেশই যদি তোমাকে দেশ না দেয়,
তবে পৃথিবীতে কোন দেশ আছে তোমাকে দেশ দেবে, বলো!
ঘুরে ফিরে দেশগুলো তো অনেকটা একইরকম,
শাসকের চেহারা চরিত্র একইরকম।
কষ্ট দিতে চাইলে একইরকম করে তোমাকে কষ্ট দেবে,
একইরকম আহ্লাদে সুঁই ফোটাবে,
তোমার কান্নার সামনে পাথর-মুখে বসে মনে মনে নৃত্য করবে।
নাম ধাম ভিন্ন হতে পারে, অন্ধকারেও ঠিকই চিনবে ওদের -
চিৎকার, ফিসফিস, হাঁটাচলার শব্দ শুনে বুঝবে কারা ওরা,
যেদিকে হাওয়া, সেদিকে ওদের দৌড়ে যাওয়ার সময়
হাওয়াই তোমাকে বলবে ওরা কারা।
শাসকেরা শেষ অবধি শাসকই।

যতই তুমি নিজেকে বোঝাও কোনও শাসকের সম্পত্তি নয় দেশ,
দেশ মানুষের, যারা ভালোবাসে দেশ, দেশ তাদের।
যতই তুমি যাকে বোঝাও এ তোমার দেশ,
তুমি একে নির্মাণ করেছো তোমার হৃদয়ে,
তোমার শ্রম আর স্বপ্নের তুলিতে এঁকেছো এর মানচিত্র।
শাসকেরা তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালে কোথায় যাবে!
কোন দেশ আর দরজা খুলে দাঁড়ায় তাড়া খাওয়া কাউকে আশ্রয় দিতে!
কোন দেশ তোমাকে আর কোন মুখে দেশ দেবে বলো!

তুমি কেউ নও এখন আর,
মানুষও বোধহয় নও।
হারাবার তোমার বাকিই বা কি আছে!
এখনই সময় জগতকে টেনে বাইরে এনে বলে দাও,
তোমাকে ওখানেই দাঁড়াবার জায়গা দিক, ওখানেই ঠাঁই দিক,
দেশের সীমানা ফুরোলে কারও মাটি নয় বলে যেটুকু মাটি থাকে,
সেই অবাঞ্ছিত মাটিই, সেটুকুই না হয় আজ থেকে তোমার দেশ হোক।

এমন দেশটি...

আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি
আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে
দূরবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,
পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।

আমার দেশ এমন ছিল না আগে,
দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল,
দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল।

দেশ এখন আর দেশ নেই।
কতগুলো স্থবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর,
এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট।
আর, ধূসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।

আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব,
এককালে কবিতা আওড়াতো খুব মানুষ,
এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দুবার ভাবে না,
এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ,
পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।

দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে,
দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে
দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা
মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা,
দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।

দুনিয়া তছনছ করে দেশ খুঁজছি এক যুগেরও বেশি,
এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে
দেশকে স্পর্শ করতে দুহাত বাড়িয়ে আছি।
আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে,
তবে নাকি আমার রক্ষে নেই।

আমার বাংলা

আমার বাংলা আর বাংলা নেই,
সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া,
আমার রূপোলি বাংলার গায়ে মরচে,
পূর্ব-পশ্চিম আজ একাকার।
ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে,
নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ।

সাহস আর সততার নির্বাসন হয়ে গেছে,
বাংলা এখন কুচক্রি শাসক আর তাঁবেদারে ঠাসা,
বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।

এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম,
কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ,
যেন দূর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।

দেশাত্মবোধক কবিতা বলতে দেশ নিয়ে উনি যা কিছু লিখেছেন, সবই দিয়ে দিলাম। আশা করি বানর থেকে বিবর্তিত হয়ে যারা মানুষের পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে, তারা এই কবিতাগুলো পড়েই বুঝতে পারবে জাহের যে কবিতাটা দিয়েছে, সেটা তসলিমা নাসরিনের লেখা নয়। মাথায় দু'ছটাক গ্রে ম্যাটার থাকলেই বোঝা যায় জাহের ওয়াসিম নিজেই কবিতাটা লিখেছে। জাহের ওয়াসিম-জাতীয় মিথ্যুকে দেশ ছেয়ে গেছে, যাচ্ছে, এবং যাবে।

যাই হোক, তসলিমা নাসরিনের এই কবিতাগুলি আমার অত প্রিয় নয়, যত প্রিয় তাঁর প্রেম, নারীবাদ, প্রতিবাদ বা নাস্তিকতার কবিতাগুলো। যেমন এটা-

সম্প্রদান

একবার ভিক্ষা চাও
এ হাত আমার হাত, এ হাতে খুদকুঁড়ো ওঠে না কখনও
দিতে হলে মোহরই দেব।

করা নেরে প্রতীক্ষায় দাঁড়াও ভিক্ষুক
কড়া নাড়ো, কড়া নাড়ো
জীবনের অযুত বছর ঘুম
একবার পারো তো ভাঙাও।
এ চোখ আমার চোখ, এ চোখের চেয়ে বেশি নীল আর আকাশ কোথায়?
তোমাকে মোহর দেব, ভয় নেই।
ভিক্ষা চাও। চেয়ে দ্যাখো
আমি আর যা কিছুই পারি
একবার দু'হাত বাড়ালে
তাকে আমি ফেরাতে পারি না।


অনেক আগে এই কবিতাটা ফেসবুকে দিয়েছিলাম। পড়ে কবি করণিক আখতার একটা মন্তব্য করেছিলেন। সেই মন্তব্যের উত্তরে আমি একটা বিরাট মন্তব্য লিখেছিলাম। কেবল জাহের ওয়াসিমদের কথা ভেবেই নয়, কবিতাগুলোর কারণেও প্রাসঙ্গিক ভেবে নিচে সেইটা তুলে দিলাম।

আসুন তসলিমা নাসরিনের জন্য লড়াই করি
০৯ নভেম্বর ২০০৯

আজ শেষ রাতে ফেসবুকে তসলিমা নাসরিনের একটি কবিতা নিয়ে তৈরী করা আমার একটি ছবি আপলোড করেছিলাম। কবিতাটি পড়ে আমারই প্রিয় আরেকজন কবি করণিক আখতার মন্তব্য করলেন - বিধাতার ভাষা।

তাঁর মন্তব্যটির পিঠে আমিও একটি মন্তব্য করলাম। তাই নিচে মন্তব্যটি তুলে দিচ্ছি -


প্রত্যেক কবিই নিজের জীবনের গল্পকে কবিতায় রুপান্তরিত করেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা না থাকলে কবিতা লেখা অসম্ভব। তসলিমা নাসরিনও তাই করেছেন। সে হিসেবে কিন্তু তসলিমা নাসরিনের জীবনে অনেক হতাশাও রয়েছে। তার কারণ তাঁর দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া। ওঁর দেশ এই বাংলাদেশ। এই দেশের আলো হাওয়ায় তাঁর মনের সমস্ত মাধুরী গড়ে উঠেছে। এই দেশকে চোখে দেখলে তাঁর কবিতার চিত্রকল্পগুলো তাঁর মনের মাঝে উড়ে আসত। এখানে না থাকলে তিনি কি করে লিখবেন? উনি ১৫ বছর ধরে দেশে আসার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। আজ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। অন্যদিকে দেশে এক এক করে তাঁর আত্মীয়রা পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে। এ হতাশা তিনি আর বইতে পারছেন না। সম্প্রতি "আমাদের সময়ে" তাঁর একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। তিনি লিখেছেন - তিনি একজন লেখক। একজন লেখকের জীবিকার মূল উৎস হোলো টাকা। আজ তিনি অর্থনৈতিক দৈন্যের শিকার। এভাবে চলতে থাকলে হতাশার শিকার হয়ে তার এক সময় আত্মহত্যা করতে হবে।"
চিঠিটি পরে আমি ভাবছিলাম, তিনি এমন কথা কেন লিখলেন! তাঁর তো এমন হতাশায় ভোগার কথা নয়! সেই মূহুর্তে মনে পড়ল, তিনি ১৯৯৮ সালে একবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। সেবারও মোল্লারা তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় পিপীলিকার মিছিলের মত বিরাট দেখতে মহা এক কদর্য শোভাযাত্রা বের করেছিল। তিনি সেবার চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেবার মারা গিয়েছিলেন তার মা। পরেরবার তাঁর বাবা যখন মারা গেলেন, তখন তাঁকে আর আসতে দেয়া হয়নি। এরপর আর আপন মানুষদের চলে যাওয়ার কথা বলে তিনি দেশে আসতে পারেননি। এখন তাঁকে অর্থনীতির কথাই বলতে হচ্ছে। যদিও দীপু মণি বলেছিলেন যে তাঁর দেশে আসতে কোন বাঁধা নেই, তবুও তাঁর চিঠিটির কোন সাড়া মেলেনি। এখন তিনি একাকী আমেরিকায় পড়াশোনা নিয়ে, থিয়েটার দেখা নিয়ে, যাদুঘর দেখা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

এতে হয়তো কারুর কোন অসুবিধা নিয়ে। কিন্তু আমার রয়েছে। কারণ, আমি সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। নিজেও লেখালেখি করি কদাচিৎ, নিজের আশা হতাশা নিয়ে। লেখকদের মনন আমার চেনা আছে। আমি খুব ভাল করেই বুঝি, তিনি নোবেল পাবার মেধা রাখেন। তিনি অনায়াসেই তা পাবেন, যদি একবার দেশে ফিরতে পারেন। তাহলে তাঁর সারা জীবনের সকল বাসনা পূর্ণ হবে। তখন আর তাঁর অসামান্য একটি কাব্যগ্রন্থ লিখতে আর কোন বাধা থাকবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনবে কে? রাজনীতি একজন লেখককে নিয়ে ইঁদুর বেড়াল খেলা খেলছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কে? কেউ না।

যখন কেউ করবে না, তখন আমাদের, এই সাধারণ মুক্তমনাদেরই করতে হবে। নচেৎ উপায় নেই। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সবচে' বড় মেধাকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। ইতিমধ্যে একজন হারিয়ে গেছেন - হুমায়ুন আজাদ। হুমায়ুন আজাদ যখন চলে গিয়েছিলেন, আমরা কি কাঁদিনি? আমরা কি আবেগে ভাসিনি? তসলিমা নাসরিনের জন্য আমাদের সেই একই করতে বাধা কোথায়? তিনি নারী? না। তিনি আসলে মহা বিতর্কিত, হুমায়ুন আজাদের থেকেও। এই বিতর্কই তাঁর জীবনে মহা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিশাপ আমরাই তাঁকে দিয়েছি, অথচ আমরা কেউ ঈশ্বর নই। আমাদের কারোর এই অভিশাপ দেবার অধিকার নেই। তাই এই অভিশাপ তুলে নিয়ে তাঁর প্রায়শ্চিত্ত আমাদেরই করতে হবে। এদিকে তিনি দৈহিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন ২০০৮ সালে ভারত থেকে বিতাড়িত হবার পর। অনেক হয়েছে। এবার এই আশ্চর্য খেলা শেষ হোক। আমাদের আরও তসলিমা নাসরিনের মত এত বড় কবি হবার ক্ষমতা নেই। তাঁর কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলোর মতই এগুলো সহজ সুরের আবেগ জাগানিয়া। এই আবেগ জীবনানন্দের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, সেগুলো এক বয়সে বোঝাই যায় না। যে বয়সে জীবনানন্দের কবিতাগুলো একবার পড়লেই বোঝা যায়, সেই বয়সে আর তা আবেগে আলোড়িত করে না। এ জন্যই হয়তো জীবনানন্দ নোবেল পান নি। তসলিমা নাসরিনের "ফরাসী প্রেমিক" প্রকাশিত হবার পর একজন সমালোচক বলেছিলেন, "তসলিমার লেখা এবার অনায়াসে নোবেল লরিয়েটদের মানে পৌঁছতে পারবেই। এ কথা কেউই অস্বীকার করবে না। " তবে তিনি যে তা রাখেন, তা বোঝার জন্য তাঁর প্রধান কবিতাগুলো পড়লেই যথেষ্ট। এই মহাকবির জন্য আমাদের সংগ্রামে নামতে হবেই। নাহলে নিজেদের প্রতিই অন্যায় করা হবে। কারণ, আমরা সবাই বাঙালী।তিনিও একজন বাঙালী, বাঙালীর জন্য বাঙালীদেরই লড়তে হয়, এবং বাঙালীদের জন্য বাঙালীরাই চিরকাল লড়াই করেছে। পাকিস্তানিরা কখনো করেনি।